Tuesday, November 5, 2024
Homeদেশজুড়েচরম গরমে স্বাস্থ্য সতর্কতা

চরম গরমে স্বাস্থ্য সতর্কতা

আলোর যুগ প্রতিনিধিঃ মানব দেহের সব ধরনের বিপাকীয় কর্মকাণ্ড সুচারুরূপে পরিচালনার জন্য দেহের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের ব্রেইন বিভিন্ন উপায়ে সদা-সর্বদা দেহের এ নির্দিষ্ট মাত্রা বজায় রাখতে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক তৎপরতার মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। উদাহরণস্বরুপ বলা যায় যে, যদি ব্যক্তি শীতের প্রভাবে তার শারীরিক তাপ হারাতে থাকে তখন শারীরিক তাপ বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন হরমোনাল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শরীরে অধিক তাপ উৎপন্ন করে শারীরিক তাপমাত্রা বজায় রাখে।

যদি এসব বিপাকীয় (হরমোনাল) কর্মকাণ্ডের পরও সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখা সম্ভব না হয়, তবে মাংসপেশি সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে তাপ উৎপাদন করে থাকে, যার ফলে অত্যধিক ঠাণ্ডা পরিবেশে মানব শরীরে কাঁপুনি হতে দেখা দেয়। যার মানে শরীর যে কোনোভাবে তার অভ্যন্তরীণ নির্দিষ্ট তাপ যা ৩৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপ বজায় রাখে। অনুরূপভাবে যদি কেউ অত্যধিক গরম আবহাওয়ায় বা পরিবেশে পতিত হয় তখন ঘাম উৎপাদনের মাধমে শরীরের তাপ বের করে দিয়ে সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখে। অত্যধিক গরম পরিবেশে মানুষের শরীরের ত্বকে রক্ত সরবরাহ বৃদ্ধি করে ঘর্ম গ্রন্থির মাধ্যমে ঘাম উৎপাদন করে থাকে, সেই ঘাম বাষ্পীভূত হয়ে বাতাসে মিশে যায়।

ঘাম বাষ্পীভূত হওয়ার সময় শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে তাপ শোষণ করে থাকে, ফলে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে শারীরিক তাপমাত্রা বজায় থাকে। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীর অধিক পরিমাণ তাপ শরীর থেকে বের করতে সাহায্য করে, অনেক সময় গরমের ফলে কুকুর হাঁপাতে থাকে, যা আমরা সচরাচর দেখে থাকি, এটাও শরীরকে গরমের প্রভাব থেকে রক্ষায় এর জৈবিক উপায় বটে।এখন আমাদের দেশে গ্রীষ্মকাল চলছে, অত্যধিক তাপপ্রবাহ ও রোদের কারণে শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রোদের কারণে মানুষের ত্বক অতি বেগুনি রশ্মির প্রভাবে ঝলসে যায়। যারা দীর্ঘ সময় রোদে পুড়ে কাজ করে তাদের অনেকের ত্বক অত্যধিক কালো বর্ণ ধারণ করে, ত্বক পুড়ে যেতে পারে।

যারা পেশাজীবী হিসেবে রোদে উন্মুক্ত থাকে যেমন মৎস্যজীবী, রিকশাচালক, কৃষিশ্রমিক তারা অধিক সময় রোদে উন্মুক্ত থাকার ফলে অকালে চোখের ছানি ও ত্বক ক্যান্সারে অধিক হারে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। অত্যধিক গরমের ফলে শরীরে প্রচুর ঘাম উৎপন্ন হয়ে শারীরিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এভাবে তাপ নিয়ন্ত্রণের ফলে খুব সহজেই শরীর পানিশূন্য হতে থাকে, ত্বকে রক্ত প্রবাহের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় শরীরের অন্যান্য অঙ্গ যেমন ব্রেইন, হার্ট, কিডনি, লিভার ইত্যাদিতে রক্ত সরবরাহ আনুপাতিক হারে কমতে থাকে, যার ফলে মাথা ঘোরা, দৃষ্টি বিভ্রম, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, মানসিক উদ্বেগ, উৎকণ্ঠাসহ অন্যান্য স্নায়বিক সমস্যায় আক্রান্ত হতে দেখা যায়। যারা অ্যাজমায় আক্রান্ত ব্যক্তি তাদের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যেতে পারে, কিডনি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিগণের কিডনির জটিলতা বৃদ্ধি পেতে পারে।

যেসব ব্যক্তি পূর্ব আগেই হার্টের সমস্যায় ভুগছেন তাদের হার্টে অসুস্থতার বৃদ্ধি পায় এবং হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হতে পারেন। রক্তচাপ অত্যধিক কমে গিয়ে মাথা ঘোরাতে পারে এবং ক্ষেত্রবিশেষে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন। এসব অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার যেমন পানি, খাবার স্যালাইন, ডাবের পানি, ফলের রস, দই, মাঠা, ঘোল ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। গরমকালে কিছু পেশাজীবী প্রতিদিন ১০ লিটার পরিমাণ পানি ঘাম হিসেবে হারাতে পারেন, তাই গরমের প্রভাবের ওপর নির্ভর করে প্রতিদিন ২/৩ লিটার থেকে ১০ লিটার পরিমাণ পানি পান করার প্রয়োজন হতে পারে।

গরমে পতিত ব্যক্তিগণ যদি প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি গ্রহণ না করতে পারে, তবে ঘাম উৎপাদন কমে যায় এবং শরীর শীতল হওয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়, ফলে শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা বৃদ্ধ পেয়ে যদি তা ৩৮˚ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেডে পৌঁছায় এই অবস্থাকে হিট এক্সারশন বলা হয়। ফলশ্রুতিতে মানুষ বিরূপ পরিস্থিতিতে পতিত হয়। এতে শরীর অত্যধিক ঘেমে যায় এবং দুর্বল হয়ে পড়ে, চোখে দেখতে সমস্যা হয়, চোখে ঝাপসা দেখে, অত্যধিক পিপাসা বোধ করে, বমির ভাব, ক্ষেত্রবিশেষে বমি হয়ে থাকে, মাথা ঘোরা, মাথা ব্যথা, শ্বাসকষ্ট অনুভূত হয়, অত্যধিক হয়রানি বা পেরেশানি দেখা দেয়, বুক ধড়ফড় করতে থাকে, মাংসপেশি বা রগে টান পড়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়, রক্ত চাপ অত্যধিক কমে যায় ক্ষেত্র বিশেষে ব্যক্তি ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারে এবং হার্ট অ্যাটাকের মতো অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে জীবন বিপন্নও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে রোগীকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঠান্ডা স্থানে সরিয়ে নিতে হবে। যদি ব্যক্তি পানি পান করতে পারে তবে ধীরে ধীরে প্রচুর পানি, খাবার স্যালাইন ও অন্যান্য তরল খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে দিতে হবে। যদি রোগী পানি পান করার মতো অবস্থায় না থাকে তবে দ্রুততার সঙ্গে হাসপাতালে প্রেরণ করা আবশ্যক।

যখন গরমের কারণে ব্যক্তির শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়ে যায় (৪০˚ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) এ অবস্থাকে হিট স্ট্রোক বলা হয়। এর ফলশ্রুতিতে শরীরের জ্বর আসা মানে তাপ অনেক বৃদ্ধি পায়, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, খিঁচুনি হওয়া, আচার-আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। এ অবস্থায় অনেকে ব্রেইন স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের মতো অবস্থায় পতিত হতে পারেন। রোগীকে দ্রুততার সঙ্গে হাসপাতালে প্রেরণ করলে অনাকাঙ্খিত বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে।

সতর্কতা হিসেবে তীব্র গরমের সময় এবং তীব্র রোদের সময় শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি, হার্ট-ডিজিজে আক্রান্ত ব্যক্তিগণ বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকবেন, বাড়িতেও পাখার নিচে অথবা এসিতে থাকতে পারলে ভালো। এ কথাগুলো অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির বেলায়ও প্রযোজ্য। এ ছাড়াও যাদের এ গরমে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হয় তারা ঢিলেঢালা সুতির বস্ত্র পরিধান করে যাবেন। সঙ্গে ছাতা, পানি ও ত্বকের উন্মুক্ত অংশে সানস্ক্রিন জাতীয় ক্রিম ব্যবহার করতে ভুলবেন না। আপনার ঘামের ফলে যতটুকু পানি শরীর থেকে বের হয়ে যায়, তার সমপরিমাণ তরল খাবার অবশ্যই পান করে পানিশূন্যতা প্রতিরোধ করবেন। টানা দীর্ঘ সময় গরমে কাজ না করে বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে কাজ করবেন। যারা অ্যাজমায় ভুগছেন তারা বাইরে যাওয়ার সময় অবশ্যই ইনহেলার সঙ্গে রাখবেন এবং হার্টের অসুস্থতার জন্য যারা নাইট্রিন জাতীয় স্প্রে ব্যবহার করে থাকেন তারা অবশ্যই স্প্রে সঙ্গে রাখবেন। সর্বোপরি, এটা মাথায় রাখতে হবে যে এই গরমে যত বেশি তরল খাবার গ্রহণ করবেন ততবেশি বেশি ঝুঁকিমুক্ত থাকতে পারবেন।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments