আলোর যুগ প্রতিনিধিঃ পেতে রাখা টাইম বোমা প্রতি সেকেন্ডে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে বিস্ফোরণের দিকে। যেকোনও মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে ভয়ংকর অঘটন। কেরালার ইদুক্কি জেলায় মুল্লাপেরিয়ার বাঁধকে সেই টাইম বোমা বলেই মনে করছেন কেরালার বাসিন্দাদের একাংশ। ১৩০ বছরের পুরনো বাঁধটি কেরালার পাঁচটি জেলায় অকল্পনীয় ধ্বংসযজ্ঞের কারণ হতে পারে বলেও আশঙ্কা তাদের।
মুল্লাপেরিয়ার কেরালারে ইদুক্কি জেলার মুল্লায়ার এবং পেরিয়ার নদীর সঙ্গমস্থলে তৈরি করা হয়েছে। ইদুক্কি জেলার থেক্কাডিতে পশ্চিমঘাটের ইয়েলা মালা পর্বতমালার কাছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮৮১ মিটার উপরে অবস্থিত বাঁধটি তৈরি করেছিলেন জন পেনিকুইক। সেই সময়ে বাঁধ দিয়ে আটকানো পানি পূর্ব দিকে সরানোর জন্য মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির সঙ্গে চুক্তিও হয়। মুল্লাপেরিয়ার বাঁধটির উচ্চতা ১৭৬ ফুট। দৈর্ঘ্য ১২০০ ফুট। তৈরি হয়েছে সুড়কি এবং চুনাপাথর দিয়ে। এই বাঁধের পাশেই রয়েছে পেরিয়ার জাতীয় উদ্যান।
কেরালা পেরিয়ার নদীর উপর অবস্থিত হলেও এটি পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করে প্রতিবেশী রাজ্য তামিলনাড়ু। খাতায়কলমে ওই বাঁধের সর্বোচ্চ পানি ধারণ ক্ষমতা ১৪২ ফুট। ২০১৪ সালের ২১ নভেম্বর গত ৩৫ বছরের মধ্যে প্রথম বার ওই বাঁধের পানির স্তর ১৪২ ফুটে উঠেছিল। কেরালায় অবিরাম বৃষ্টির পরে ২০১৮-এর ১৫ অগস্ট জলাধারটি আবার ১৪২ ফুটের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছিল।
২০২১ সালের জাতিসংঘের এক রিপোর্টে উঠে আসে, মুল্লাপেরিয়ারে উল্লেখযোগ্য কাঠামোগত ত্রুটি দেখা গিয়েছে। পাশাপাশি বাঁধটি ভূকিকম্পপ্রবণ এলাকায় তৈরি হয়েছে বলেও জানানো হয়। যদি বাঁধটি ভেঙে পড়ে, তাহলে ৩৫ লক্ষ মানুষের জীবনে বিপদ ডেকে আনবে। তবে বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, সেই সংখ্যা এখন আর ৩৫ লাখে সীমাবদ্ধ নয়। মুল্লাপেরিয়ার বাঁধের নিরাপত্তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এমন বিশেষজ্ঞদের মতে, বাঁধটি যখন-তখন ভেঙে পড়তে পারে। আর এখন যদি সেটা ভাঙে তা হলে এলাকার পর এলাকা ভেসে যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ৪৫ লক্ষ মানুষ। সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশনের সাবেক ডিরেক্টর জেনারেল এমএস মেনন সংবাদমাধ্যম ‘দ্য পাইওনিয়ার’-কে বলেছেন, “বাঁধটির আনুমানিক জীবদ্দশা কয়েক দশক আগেই পেরিয়ে গিয়েছে। এখন একমাত্র বিকল্প এই বাঁধটিকে বাতিল ঘোষণা করে একটি নতুন বাঁধ তৈরি করা।’’
বহু দিন ধরেই মুল্লাপেরিয়ার বাঁধ দিয়ে সংঘাত রয়েছে কেরল এবং তামিলনাড়ুর মধ্যে। মুল্লাপেরিয়ার বাঁধটি কেরলে অবস্থিত হলেও তামিলনাড়ু থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়। কেরলের অভিযোগ, অতীতে বহু বার বাঁধ থেকে আচমকা পানি ছেড়ে মানুষকে বিপদে ফেলা হয়েছে। ফলে এ নিয়ে দীর্ঘ দিন থেকেই বিবাদ রয়েছে দুই রাজ্যের। পানি ছাড়ার বিষয়ে কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন একাধিক বার চিঠিও লিখেছেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিনকে। মুল্লাপেরিয়ার নিয়ে দু’রাজ্যের সংঘাত গড়িয়েছে সুপ্রিম কোর্টেও। সেই বাঁধের স্বাস্থ্যই এবার ভাবাচ্ছে বিশেষজ্ঞদের। মেননের কথায়, “নিরাপত্তার দিকগুলি ছাড়াও এই বাঁধ নিয়ে বিতর্ক যে ভাবে রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে তাতে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। বাঁধটি পেরিয়ার নদী জুড়ে নির্মিত, যা আন্তঃরাজ্য নদী নয়। ফলে নতুন বাঁধ নির্মাণে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কেরল সরকারকে তামিলনাড়ুর থেকে কোনও সবুজ সঙ্কেত পাওয়ার অপেক্ষা করতে হবে না।”
মুল্লাপেরিয়ার বাঁধের সুরক্ষা নিয়ে গবেষণা করা অন্য এক বিশেষজ্ঞে তথা অধ্যাপক এসকে গোঁসাইয়ের কথায়, জলাধারটি জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে এবং যে কোনও সময় ভেঙে পড়তে পারে। গোঁসাই জানিয়েছেন, ১৯৯০-এর দশকে তাঁর গবেষণাতেই নতুন বাঁধ তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথা উঠে আসে।