আলোর যুগ প্রতিনিধিঃ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিষয়ে পক্ষগুলোকে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আদেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ আজ বুধবার দুপুর ১২টার দিকে পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনাসহ এ আদেশ দেন। চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা দেওয়া হলো উল্লেখ করে আপিল বিভাগ আগামী ৭ আগস্ট পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছেন।
পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনায় আপিল বিভাগ বলেছেন, সব প্রতিবাদী কোমলমতি ছাত্রছাত্রীকে নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে গিয়ে নিজ নিজ কাজে, অর্থাৎ পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে বলা হলো। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রক্টর এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানেরা তাদের ছাত্রছাত্রীদের নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে নিয়ে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করবেন বলে আদালত আশা করেন। স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদকারী শিক্ষার্থীরা চাইলে আইনজীবীর মাধ্যমে তাঁদের বক্তব্য এই আদালতের সামনে তুলে ধরতে পারেন। আদালত মূল আবেদন নিষ্পত্তির সময় তাদের বক্তব্য বিবেচনায় নেবেন। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন, দুই শিক্ষার্থীর পক্ষে সিনিয়র আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক ও রিট আবেদনকারীদের পক্ষে সিনিয়র আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী শুনানি করেন।
আদেশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি ছিল, পরবর্তীতে ২০১৮ সালে সরকার একটি কমিটি করে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে সেটা বাতিল করে দিয়ে পরিপত্র জারি করে। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকুরির ক্ষেত্রে সেটা বহাল থাকে। পরবর্তীতে এটা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি মামলা হয়। সেই মামলায় শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট বিভাগ রায়ে কোটা পদ্ধতি বাতিলের পরিপত্র বাতিল করে দিয়েছেন। অর্থাৎ হাইকোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে কোটা পদ্ধতি যেটা আগে ছিল, সেটাই আবার বহাল হয়ে যায়। আমরা এই রায় চ্যালেঞ্জ করে আপিল বিভাগে আবেদন করি। তবে যেহেতু পূর্ণাঙ্গ রায়টি এখনো পাওয়া যায়নি, তাই আমরা সিএমপি ফাইল করি। এই সিএমপি আজকে শুনানি হলো।
তিনি বলেন, আমরা কোর্টকে বলেছি, এখনো রায়ের অনুলিপি পাওয়া যায়নি। রায় না পাওয়া পর্যন্ত আমরা কিছু করতে পারছি না। যেহেতু গত ৫ বছর ধরে কোটা পদ্ধতিটা বিলুপ্ত ছিল। সেই ক্ষেত্রে নতুন করে রায় না পাওয়া পর্যন্ত হাইকোর্টের রায়ের ওপর আমরা স্থগিতাদেশ চেয়েছিলাম। উভয়পক্ষকে শুনানি করে আপিল বিভাগ স্থিতাবস্থা দিয়েছেন। অর্থাৎ যে অবস্থায় আছে, সেই অবস্থায়ই থাকবে। চাকুরিগুলো যেগুলো চলমান আছে, সেগুলো সবই ঠিক থাকবে। এই স্থিতাবস্থার কারণে হাইকোর্টের রায়টি এখন আর কার্যকর হবে না।
আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে অ্যটার্নি জেনারেল বলেন, আমি তাদের বলবো, সুপ্রিম কোর্ট এটা (তাদের দাবি) বিবেচনায় নিয়েছেন, সুপ্রিম কোর্টের আদেশেও আছে আন্দোলনকারীদের কোন বক্তব্য থাকলে তারা আইনজীবীর মাধ্যমে আপিল বিভাগে দিতে পারবে। তাই এখন আন্দোলন চালিয়ে জনদুর্ভোগ বাড়ানোর আর কোন যৌক্তিকতা নেই। এখন উচিত নিজ নিজ অবস্থানে ফিরে যাওয়া। কোটার প্রকৃত অবস্থা কী হলো এখন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আগে যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায়ই আছে। স্থিতাবস্থা দেওয়া হয়েছে সাবজেক্ট ম্যাটারে। সাবজেক্ট ম্যাটারে এটা বাতিল করা ছিল। যে বিজ্ঞপ্তিগুলো রয়েছে, সেগুলোতে কোটা পদ্ধতি লাগবে না। নতুন করে কোন বিজ্ঞপ্তি দিতে হলে, এখন আপাতত কিছু করবে না। মামলাটা আগামী ৭ তারিখে শুনানি হবে, তখন ঠিক করবে এটা।
যা বললেন প্রধান বিচারপতি: আদেশর আগে প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরাতো এই সমাজের মানুষ। কিছু কথা বলতে হয়। সেটা হচ্ছে যে, হাইকোর্টে একটা রায় হয়ে গেছে। আমাদের যে সকল ছাত্র-ছাত্রীরা আন্দোলন করছে, তাদের মনে একটা বিবাদ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা এর থেকে বের হওয়ার পথ যেটা মনে করছে, তারা সেটাই করছে। প্রধান বিচারপতি বলেন, তারা (আন্দোলনকারীরা) রাস্তায় নেমেছে, রাস্তায় নেমে স্লোগান দিয়েছে। সেখানে তারা যেটা করেছে, এটা এপ্রিশিয়েট করার মতো না। তবে আমার যা মনে হয়, তারা ভুল বুঝেই করেছে। যাই হোক তারা আমাদেরই ছেলে-মেয়ে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আমি প্রথম দিনেই বলেছিলাম, রাস্তায় স্লোগান দিয়ে রায় জাজমেন্ট হয় না। এটা আজকে না, আমি যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ছিলাম তখন আরও একটি মামলায় বলেছিলাম রাস্তায় স্লোগান দিয়ে জাজমেন্ট চেঞ্জ করতে পারবেন না। এটার জন্য সঠিক পদ্ধতি না। আজকে আমি ধন্যবাদ জানাই শাহ মঞ্জুরুল হককে। তারা অন্তত পক্ষে একটি উদ্যোগ নিয়েছে। রাস্তায় যে ছেলে মেয়েরা আন্দোলন করছে, তাদের কিছু কথাতো আছে। এই কথাগুলো শুনবে কে, প্রশ্ন করেন প্রধান বিচারপতি।
প্রধান বিচারপতি বলেন, রাতে টেলিভিশন যখন দেখি, মনে হয় সমস্ত জ্ঞান তাদেরই। আর আমরা যারা এখানে বসে আছি, আমাদের কোন জ্ঞানই নাই। কারো মাথার মধ্যে কিচ্ছু নেই। এত কথা বলে উস্কানি দেওয়ারতো কোন মানে হয় না। তিনি বলেন, হাইকোর্ট একভাবে সলভ করেছে। এখন সেটা সঠিক হয়েছে কি-না, তা দেখার অধিকারটা কার? সুপ্রিম কোর্টের। একমাত্র আপিল বিভাগের। আপিল বিভাগ ছাড়া কোনভাবেই সম্ভব না। এই কথাটা এই বাচ্চাদের কেউ বলেন না কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যারা বড় বড় জায়গায় আছেন, তাদের (শিক্ষার্থীদের) বলেন- এটাতো পথ না, তোমরা যাও কোর্টে। কোর্টে গেলে কোর্ট সেটা দেখবে। আমাদের ক্ষমতা আছে আমরা হাইকোর্টের রায়টি বাতিল করে দিতে পারি। সরকারকে ডিরেকশন দিতে পারি। ইউ ডু ইট, ডোন্ট ডু ইট, দুইটাই বলতে পারি। আবার বলতে পারি, হাইকোর্টের রায়টি, রায়টি ঠিক হয়নি, রায়টি ঠিক হয়েছেও বলতে পারি। তবে কোনটা বলবো, রায়টি আমাদের সামনে না আসার পরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, এই পর্যন্ত যা হয়েছে, এনাফ ইজ এনাফ। আমার মনে হয় রায়টি আমাদের সামনে আসুক, রায়টি আসলে আমরা সঠিক মূল্যায়ন করবো। তাই এই পর্যায়ে আমরা উভয় পক্ষের আইনজীবীদের শুনানি নিয়ে আমরা পর্যবেক্ষণসহ আদেশ দিচ্ছি। আমরা বিষয়টির সাবজেক্ট ম্যাটারের ওপর চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দিচ্ছি। এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য ৭ আগস্ট দিন নির্ধারণ করছি।
ফিরে দেখা: কোটা সংস্কার আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত কোটাপদ্ধতি বাতিল করে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে রিট করেন চাকরিপ্রত্যাশী ও বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করে গত ৫ জুন রায় দেন হাইকোর্ট।
হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদন চেম্বার আদালত হয়ে ৪ জুলাই আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য ওঠে। রিট আবেদনকারীপক্ষের সময়ের আরজির পরিপ্রেক্ষিতে সেদিন আপিল বিভাগ নট টুডে (৪ জুলাই নয়) বলে আদেশ দেন। পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষকে নিয়মিত লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করতে বলা হয়। এ অবস্থায় কোটা পুনর্বহালসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে দুই শিক্ষার্থী গতকাল মঙ্গলবার আবেদন করেন। দুই শিক্ষার্থী ও রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদন শুনানির জন্য আজ আপিল বিভাগে ওঠে। শুনানি শেষে আদেশ দেন আপিল বিভাগ।