আলোর যুগ প্রতিনিধিঃ বিশ্ব নজরে গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি। জিম্মি আর বন্দি আদানপ্রদানের গল্প ছাপাতে ব্যস্ত বাঘাবাঘা গণমাধ্যমগুলো। ঠিক তার আড়ালেই নতুন সহিংস কাণ্ড আর দখলদারিত্ব শুরু করেছে ইসরায়েল। গাজা ছেড়ে এবার তারা চোখ দিয়েছে ফিলিস্তিনের আরেক খণ্ডিত অংশে। ধীরে তারা গিলে খাচ্ছে পশ্চিম তীরকে।
গাজা থেকে মাত্র ৩৩ কিলোমিটার (২১ মাইল) দূরে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী এবং সেনাদের ফিলিস্তিনিদের ওপর দৈনন্দিন আক্রমণ ও অভিযান তীব্র আকার ধারণ করেছে। বসতি স্থাপনকারীদের এই হামলা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে তারা তাদের জমি ও জীবিকা রক্ষার জন্য সংগ্রাম করে চলেছে।
সাম্প্রতিক হামলার চিত্র
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, সোমবার রাতে জর্ডান উপত্যকার উত্তরের বারদালা গ্রামে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা ১৫০টি জলপাই গাছ উপড়ে ফেলেছে। এই জলপাই গাছগুলো কয়েকটি ফিলিস্তিনি পরিবারের জীবিকার প্রধান উৎস ছিল। স্থানীয় ফিলিস্তিনি ভূমি দখলের প্রচেষ্টা, অবৈধ বসতি স্থাপন সম্প্রসারণ এবং স্থানীয় সম্প্রদায়কে ভয় দেখিয়ে বিতাড়িত করার উদ্দেশ্যে বসতি স্থাপনকারীরা নিয়মিতভাবে বারদালার জমিতে অনুপ্রবেশ করে। তারা ফসল ধ্বংস করে এবং সম্পত্তি পুড়িয়ে দেয়।
এর আগে সোমবার বেথলেহেমের দক্ষিণে বেইত ফাজ্জারের বসতি স্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনি কৃষকদের ওপর হামলা চালায়, এতে বেশ কয়েকজন কৃষক আহত হন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, হামলাকারীরা পাথর ছুঁড়েছে, মানুষের উপর কুকুর লেলিয়ে দিয়েছে এবং যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
পরিসংখ্যান যা বলছে
২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে ইসরায়েলের গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
জাতিসংঘের মানবিক সমন্বয় দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে বসতি স্থাপনকারীরা অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ওপর প্রায় ৩ হাজার বার হামলা চালিয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে এই হামলার সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। ২০২২ সালে ৮৫২টি হামলার ঘটনা ঘটেছিলো। ২০২৩ সালে সেই সংখ্যা ১২শ’ ৯১টিতে দাঁড়ায়। ২০২৪ সালে ১,৪৪৯টি হামলার ঘটনা নথিবদ্ধ করা হয়।
আর ২০২৫ সালের প্রথম আট মাসেই এক হাজারের বেশি হামলার ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। যা এরইমধ্যে চলতি বছরকে সবচেয়ে সহিংস বছরে পরিণত করার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বসতি স্থাপনকারীদের আক্রমণ সাধারণত সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত জলপাই তোলার মৌসুমেই আক্রমণের তীব্রতা বাড়ায়। এই সময় অনেক ফিলিস্তিনি পরিবারের জীবিকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হামলার মূল লক্ষ্য থাকে ফিলিস্তিনিদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া।
আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন
১৯৬৭ সালে ইসরায়েলের দখল করা ফিলিস্তিনি ভূমিতে গড়ে ওঠা এই ইসরায়েলি বসতিগুলি আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ বলে বিবেচিত। বর্তমানে, অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেম জুড়ে ২৫০টিরও বেশি বসতি ও ফাঁড়িতে ৬ লক্ষ থেকে ৭.৫ লক্ষ বসতি স্থাপনকারী বসবাস করে। এদের অনেকেই ফিলিস্তিনি শহর ও গ্রামের কাছাকাছি বসবাস করে। ফলে প্রায়শই চরম উত্তেজনা দেখা দেয়। ফিলিস্তিনিদের চলাচলে তীব্র বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। বসতি স্থাপনকারীরা প্রায়শই সশস্ত্র থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে ইসরায়েলি সৈন্যদের সুরক্ষা বা সঙ্গ পায়।
কোন অঞ্চলগুলিতে হামলা বেশি?
গত দুই বছরে অধিকৃত পশ্চিম তীরের প্রতিটি গভর্নরেটেই বসতি স্থাপনকারীদের আক্রমণের শিকার হয়েছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত ওসিএইচএ-এর তথ্যানুসারে, রামাল্লাহ এবং এল-বিরেহ গভর্নরেটে সবচেয়ে বেশি হামলা হয়েছে (৬৩৪টি)। এরপরে রয়েছে নাবলুস (৫০১টি) এবং হেবরন (৪৬২টি)।
বেশিরভাগ আক্রমণই এরিয়া সি’তে কেন্দ্রীভূত, যা অধিকৃত পশ্চিম তীরের ৬০ শতাংশেরও বেশি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এবং সম্পূর্ণভাবে ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে।
হতাহত ও বাস্তুচ্যুতি
জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে ইসরায়েলি বাহিনী এবং সশস্ত্র বসতি স্থাপনকারীদের হাতে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ১,০০০-এরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত এবং প্রায় ১০,০০০ আহত হয়েছেন। শুধুমাত্র ২০২৫ সালেই ওসিএইচএ বসতি স্থাপনকারী ও সামরিক সহিংসতায় অন্তত ১৭৮ জন ফিলিস্তিনির মৃত্যুর ঘটনা নথিভুক্ত করেছে।
বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতার কারণে ব্যাপক বাস্তুচ্যুতিও ঘটছে। গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা এবং চলাচলের বিধিনিষেধের কারণে অন্তত ৩,৪৩৪ জন ফিলিস্তিনি তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।