ফায়াজুন্নেসা চৌধুরী 🇧🇩
শিশুর জন্ম মানেই আনন্দ, উল্লাস আর আশার আলো—এটাই আমাদের প্রচলিত ধারণা। কিন্তু বাস্তবতার ছবিটা সবসময় এত উজ্জ্বল নয়। সন্তান জন্মের পর এক ধরনের নীরব অন্ধকারে ডুবে যান অনেক মা। সেই অন্ধকারের নাম পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন (Postpartum Depression, PPD)।
আমাদের সমাজে এখনো অনেকেই মনে করেন, মা হলে নারীর জীবন পূর্ণতা পায়, তাই তার সবসময় খুশি থাকা উচিত। কিন্তু সন্তান জন্মের পর হরমোন পরিবর্তন, শারীরিক ক্লান্তি, ঘুমের অভাব, সামাজিক চাপ আর একাকিত্ব—সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ মানসিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হয় বহু নারীকে। দুঃখজনকভাবে, আমরা সেই যন্ত্রণার কথা শুনি না, শুনলেও গুরুত্ব দিই না।
আগে কেন চোখে পড়ত না?
প্রশ্ন আসে, ‘আগের দিনে তো মায়েরা ৮/১০টি সন্তান জন্ম দিয়ে বড় করেছেন, তখন তো পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন শোনা যেত না!’ এর উত্তর আসলে সামাজিক প্রেক্ষাপটে খুঁজে পাওয়া যায়—
যৌথ পরিবারে সাপোর্ট: মায়ের পাশে থাকতেন দাদি-নানি, খালা-চাচি, প্রতিবেশী। কাজ ভাগ হয়ে যেত, মানসিক চাপ কম হতো।
কম সামাজিক চাপ: তখনকার দিনে ‘পারফেক্ট মা’ হওয়ার প্রতিযোগিতা ছিল না।
অপ্রকাশিত কষ্ট: মানসিক অসুস্থতাকে দুর্বলতা ধরা হতো। অনেক মা হয়তো ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছেন, কিন্তু প্রকাশ করেননি।
প্রকৃতিনির্ভর জীবন: বর্তমানের মতো সোশ্যাল মিডিয়া ও ক্যারিয়ারের চাপ ছিল না।
তাই সমস্যা ছিল, কিন্তু আলোচনায় আসেনি।
এখন কেন বেশি দেখা যাচ্ছে?
আজকের দিনে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন আরও দৃশ্যমান হওয়ার কারণগুলো হলো—
নিউক্লিয়ার পরিবার: অনেক মা একা হাতে সন্তান সামলাচ্ছেন।
কর্মজীবী মায়েরা: মাতৃত্বকালীন ছুটি কম, দ্রুত কাজে ফিরতে হয়।
সোশ্যাল মিডিয়া চাপ: সবাই চায় মা হবেন নিখুঁত, সন্তানও নিখুঁত হবে।
দ্রুত তথ্যপ্রবাহ: আগে যা অজানা থেকে যেত, এখন মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে যায়।
মায়ের মনের অন্ধকার
পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন কোনো সাধারণ ‘মন খারাপ’ নয়। এতে মায়ের কান্না পায়, আগ্রহ হারায়। আত্মবিশ্বাস কমে যায়, নিজেকে ব্যর্থ মনে হয়। ঘুমের অভাব, ক্লান্তি ও ভয়ের মধ্যে দিন কাটে। কখনো কখনো ভয়াবহ পর্যায়ে গিয়ে তৈরি হয় Postpartum Psychosis—যেখানে মা বিভ্রমে ভোগেন এবং শিশুকে বা নিজেকে ক্ষতি করার ঝুঁকি থাকে।
বাংলাদেশের কিছু বাস্তব চিত্র
গবেষণা বলছে: গ্রামীণ এলাকায় ৬–১৬ মাস বয়সী সন্তানের মায়েদের মধ্যে প্রায় ৫২%-এর মধ্যে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের লক্ষণ পাওয়া যায়। ঢাকা শহরের বস্তি এলাকায় এই হার প্রায় ৪০%। খুলনার একটি হাসপাতালে করা গবেষণায় এই হার ৩৫%।
ভয়াবহ উদাহরণ: সম্প্রতি তারাগঞ্জে এক মা ছয় মাস বয়সী কন্যাশিশুকে হত্যা করেছেন, যা শিউরে ওঠার মতো ঘটনা। স্থানীয়রা বলছেন, ওই মা সন্তান জন্মের পর থেকেই অস্বাভাবিক আচরণ করছিলেন।
ফিলিসাইড মামলা: এক মা নিজের ৩২ দিনের নবজাতককে ফ্রিজে রেখেছিলেন—পরে স্বীকার করেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিলেন।
এসব ঘটনা আমাদের সামনে এক ভয়ংকর প্রশ্ন তুলে ধরে—আমরা কি নতুন মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিচ্ছি?
কারা বেশি ঝুঁকিতে?
সন্তান জন্মের পর একজন মা অনেকটা শিশুর মতোই অসহায় হয়ে পড়েন। তখন তার সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে ওঠে পরিবার। কিন্তু সেই পরিবার যদি পাশে না দাঁড়ায়, মা ধীরে ধীরে মানসিক অন্ধকারে তলিয়ে যেতে থাকেন।
যেসব নারী আগে থেকেই ডিপ্রেশন বা উদ্বেগে ভুগছেন, তাদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। সন্তান জন্মের পর শারীরিক যন্ত্রণা ও হরমোনের পরিবর্তনের সঙ্গে এই মানসিক চাপ যোগ হলে তারা ভেঙে পড়েন দ্রুত।
কিন্তু মানসিক অস্থিরতার আসল জায়গা তৈরি হয় তখন, যখন স্বামী, শ্বশুরবাড়ি আর বাবার বাড়ি—কেউ প্রকৃত সহায়তায় এগিয়ে আসে না।
স্বামী যদি শুধু দায়িত্ব মায়ের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে নিজের কাজের জগতে হারিয়ে যান, শ্বশুরবাড়ি যদি সমালোচনা করে—‘তুমি মা হয়েও এটা পারছো না?’—আর বাবার বাড়ি দূরে থাকায় যদি পাশে এসে দাঁড়াতে না পারে, তখন মা সত্যিই একা হয়ে যান।
অর্থনৈতিক সংকট এই কষ্টকে আরও বেড়ে তোলে। সন্তানের দুধ, ওষুধ, নিজের চিকিৎসা—সবকিছুর হিসাব মেলাতে না পেরে মা ভেতরে ভেতরে দম বন্ধ হয়ে যায়। এর সঙ্গে যোগ হয় ঘুমের অভাব। রাতের পর রাত শিশুর কান্নায় জেগে থাকা, বিশ্রাম না পাওয়া—এগুলো ধীরে ধীরে মায়ের মানসিক ভারসাম্য কেড়ে নেয়।
যাদের একসঙ্গে একাধিক সন্তান সামলাতে হয়, তাদের অবস্থাটা আরও কঠিন। একদিকে নবজাতক, অন্যদিকে বড় সন্তানের খেয়াল রাখা—সব মিলিয়ে মায়ের ভেতরের চাপ অসহনীয় হয়ে ওঠে।
মায়ের পাশে যদি কেউ একটু গরম ভাত এগিয়ে দেয়, শিশুকে কিছু সময় কোলে নেয়, রাতে ঘুম থেকে উঠে মাকে বলে—‘তুমি একটু ঘুমাও, আমি সামলাই’—তাহলেই অর্ধেক অন্ধকার সরে যায়। কিন্তু এই ছোট ছোট সহানুভূতি যদি না পাওয়া যায়, তখনই মায়ের ভেতরের আলো নিভে যেতে থাকে।
সহজ কথায়, একজন মায়ের ঝুঁকি তখনই বাড়ে, যখন তার চারপাশের সবচেয়ে কাছের মানুষগুলো তাকে একা ফেলে রাখে।
সমাধান কী?
পরিবারের ভূমিকা
সন্তান জন্মের পর একজন মা আসলে নতুন করে জন্ম নেন। তখন তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল, মানসিকভাবেও ভঙ্গুর। এ সময় পরিবারের কাজ শুধু তাকে রান্না-পরিষ্কার থেকে মুক্ত করা নয়, বরং তার পাশে থাকা, তার কান্না বোঝা।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যেখানে পরিবার সক্রিয়ভাবে নতুন মাকে সহায়তা করে, সেখানে ডিপ্রেশনের ঝুঁকি ৩০–৪০% কমে যায়। ‘এক প্লেট গরম ভাত এগিয়ে দেওয়া’ কিংবা ‘শিশুকে কয়েক ঘণ্টা কোলে নেওয়া’—এমন ছোট ছোট কাজই মায়ের জীবনে বিশাল স্বস্তি আনে।
সন্তান জন্ম কেবল মায়ের নয়, বাবারও জন্ম। সন্তানের যত্নে বাবার সমান দায়িত্ব থাকা উচিত। কিন্তু দুঃখজনকভাবে অনেক স্বামী এখনো মনে করেন, সব দায়িত্ব স্ত্রীর।
অথচ একজন স্বামী যদি বলেন—‘তুমি একা নও, আমরা একসঙ্গে’—তাহলেই মায়ের ভেতরের অন্ধকার অনেকটা হালকা হয়ে যায়। গবেষণা বলছে, স্বামীর সক্রিয় সমর্থন থাকলে মায়ের মানসিক অবস্থার উন্নতি দ্রুত হয়।
আমরা এখনো মানসিক স্বাস্থ্যকে ‘নাটক’ বা ‘দুর্বলতা’ বলে উড়িয়ে দিই। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে প্রতি ৬ জন মায়ের মধ্যে ১ জন পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনে ভোগেন। বাংলাদেশেও এই হার অনেক বেশি। তাই সচেতনতা তৈরি জরুরি—পরিবারে, সমাজে, মিডিয়ায়।
পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন একটি চিকিৎসাযোগ্য মানসিক অসুস্থতা। কাউন্সেলিং, সাইকোথেরাপি ও প্রয়োজনে ওষুধের মাধ্যমে প্রায় ৭০–৮০% মা সুস্থ হয়ে ওঠেন।
কিন্তু সমস্যা হলো—বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এখনো সীমিত। stigma থাকার কারণে অনেকেই চিকিৎসা নেন না। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সহজলভ্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এখন জরুরি।
মাতৃত্ব নিঃসন্দেহে আনন্দের, কিন্তু সেই আনন্দের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বিষণ্নতাকে স্বীকার না করলে আমরা ভয়াবহ পরিণতি দেখতে বাধ্য হবো।
সময় এসেছে—‘মা তো মা-ই, সব সহ্য করতে হবে’—এই ধারণা বদলানোর। কারণ, নতুন জীবনের নিরাপত্তা নির্ভর করে মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর।
একটি সুস্থ শিশুর জন্য আগে দরকার একটি সুস্থ মা। মায়ের শরীর যেমন যত্ন চায়, তেমনি তার মনও যত্ন চায়। পরিবার, স্বামী, সমাজ—সবাই যদি মায়ের পাশে দাঁড়ায়, তবে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন আর কোনো অন্ধকার নয়, বরং আলোয় ফেরার এক নতুন গল্প হয়ে উঠবে।
লেখন: প্রভাষক, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল