
সাভারের কর্মোদ্দীপনার মডেল জুঁই আক্তার।পেয়েছেন সফল জয়ীতা নারী পুরুষ্কার।
জাভেদ মোস্তফা 🇧🇩
সাভারের কর্মোদ্দীপনার মডেল জুঁই আক্তার। মাটির তৈরী গয়না তৈরী করে পেয়েছেন সফল “জয়ীতা নারী পুরুষ্কার”।
পারিবারিক জীবনে দুই ছেলের জননী জুঁই আক্তার এখন সাভারের অনেকের কাছেই কর্মোদ্দীপনার মডেল। তিনি সাভারে মাটির গয়না ও পন্যতৈরী করে খ্যাতি অর্জন করেছেন। গ্রামীন ব্যাংক এর ৫০ হাজার টাকা দিয়ে মাটির পন্য ও গয়না তৈরীর কাজ দিয়ে শুরু তার এই ব্যবসা। এর পর ২০২০ সালে তিনি সফল” জয়ীতা নারী পুরুষ্কার” অর্জন করেছেন। তাঁর মাটির পণ্যের মধ্যে রয়েছে গলার মালা, হাতের চুড়ি, কানের দুল, হাতের ব্রেসলেট, কলমদানি, ওয়ালটপ, হাতের বালা, কানের ঝুমকা ইত্যাদি।
জুই আখতার যুগান্তরকে বলেন, ২০০৯ সালে ঘরোয়া ভাবে মাটির পন্য শুরু করলেও ২০১২ সালে “বাংলাদেশর সাজ” নাম দিয়ে স্থানীয় চরুকলার মো: হাসান ভাই এর সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন এবং ব্যাবসার প্রসার বাড়াতে থাকেন। এর পর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি এই উদোক্তাকে।
পরিবারের সকল খরচ তুলে দুই ছেলেকে মানুষ করেছেন। বড় ছেলে জিতু খান স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স করে এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করছেন।দ্বিতীয় ছেলে সাকিব হোসেন খান উচ্চমাধ্যমিক এর ছাত্র। স্বামীকে করে দিয়েছেন বাড়ীর পাশে একটি লন্ডরী। শশুর বাড়ীর ১ শতাংশ জমির পাশে আরো দেড় শতাংশ জমি কিনে বাড়ী করেছেন। টিনের ঘর থেকে পাকা বাড়ী করেছেন।
তার প্রতিষ্ঠানে প্রথমে ৫/৭ জনকে নিয়ে এই ব্যাবসা শুরু করলেও পরে এলাকার অর্ধশত নারী তার সাথে কাজ শুরু করেন। এখন আর তাদের সহযোগিতা লাগে না। তারা একএকজন নিজেরাই উদোক্তা। এখন তারা নিজ বাসায় তৈরী গহনা পৌঁছে দেন জুই এর প্রতিষ্ঠানে। সে গুলি যায় ঢাকার গুলশান, বনানীর, আরোঙ সহ অভিজাত শপিং মলে।জাপান সহ কয়েকটি দেশেও তার তৈরী পন্য রফতানি ও বাজারজাত করা হয়। এখন নিজ প্রতিষ্ঠান ৪/৫ জন কারিগর নিয়েই তার পন্য উৎপাদন করে যাচ্ছেন।
জুঁই আখতার আরো বলেন,
বাংলার প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে তিনি বদ্ধপরিকর। দেশের মানুষকে জিনিস পরিধন করিয়ে দেশের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করাই উদ্দেশ্য। বাঙালির ঐতিহ্য মাটির শিল্প যেন দিন দিন কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে। তাই মাটির শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে মাটির তৈরি জিনিসপত্র ব্যবহার বাড়াতে আমরা কাজ করছি। তিনি বলেন,
আমাদের দেশের সবচেয়ে প্রাচীন শিল্প হচ্ছে মাটির শিল্প। মাটির তৈরি শিল্পকর্মকে আমরা বলি মৃৎশিল্প। কারণ, এ শিল্পের প্রধান উপকরণ হলো মাটি। তবে সব মাটি দিয়ে যে এ কাজ হয় তা নয়। এ কাজে পরিস্কার এঁটেল মাটির প্রয়োজন। কেননা, এঁটেল মাটি বেশ আঠালো। দোআঁশ মাটি তেমন আঠালো নয়। আর বেলে মাটি তো ঝরঝরে তাই এগুলো দিয়ে মাটির শিল্প হয় না। আমার এঁটেল মাটি হলেই যে তা দিয়ে এই শিল্পের কাজ করা যাবে তা-ও নয়। এর জন্য অনেক যত্ন আর শ্রম দরকার। দরকার হাতের নৈপুণ্য ও কারিগরি জ্ঞান। তবে আমাদের কাছে এসব খুব সহজ। তবে পরিতাপের বিষয়, আজকাল মাটির তৈরি জিনিস আগের মতো আর আমাদের চোখে পড়ে না। বলা যায়, বাঙালির ঐতিহ্য মাটির শিল্প যেন দিন দিন কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে। তাই মাটির শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে মাটির তৈরি জিনিসপত্র ব্যবহার বাড়াতে আমরা কাজ করছি। এর জন্য সহজ শর্তে সুদের হার কমিয় উদ্যোক্তাদের লোন দিয়ে সহায়তা করা উচিত। তিনি বলেন সহজ শর্তে ব্যাংক লোন পেলে তিনি এই ব্যাবসার আরো প্রসার ঘটাতে পারেন।
কারখনার উদোক্তারা বলেন,মাটি দিয়ে আমরা অনেক ধরণের প্রয়োজনীয় শৌখিন পণ্য তৈরি করি। হাতের তৈরি জিনিস দিয়ে কারিগরি জ্ঞান ব্যবহার করে এগুলো তৈরি করে থাকি।


জুই এর স্বামী ফারক খান এই প্রতিবেদককে বলেন,২০১২ সালে প্রতিবেশি ফারুক হাসান ভাই এর অনুপ্রেরণায় জুঁই মাটি দিয়ে বিভিন্ন হাতের কাজ করতে শুরু করে। প্রথমে সে খাল থেকে মাটি তোলে এনে তার হাতের কাজ শুরু করে। সে মূলত মাটির গহনা তৈরি করত এবং এ গহনাগুলো পোড়ানোর জন্য যে চুলার প্রয়োজন সেই চুলা তার ছিল না। তাই গহনাগুলো পুড়িয়ে শক্ত করার জন্য অন্য জনের সাহায্যের প্রয়োজন হতো। কিন্তু তখন তাকে এ কাজে কেউ সহায়তা করতে চাইতো না। এক পর্যায়ে জুঁই কুমারের বাড়িতে যায় এবং কুমার তাকে গহনা পোড়াতে সহযোগিতা করে। এক সময়ে কুমার তাকে তার বাড়িতে গহনা পোড়ানার জন্য চুলা বানিয়ে দেয়। পোড়ানো গহনা বাজারজাত করতে হলে তার বানানো গহনাতে কারুকাজ করা প্রয়োজন। কারুকাজ করতে হলে বিভিন্ন সরঞ্জামও কিনতে হবে। এই সরঞ্জামগুলো কেনার জন্য তার হাতে কোন মূলধন ছিল না। এ সময়ে সাভার ওয়াইডাব্লিউসি এর সেভিং এন্ড ক্রেডিট কর্মী সুফিয়া বেগমের সাথে তার দেখা হয় এবং তার পরামর্শে সমিতিতে যোগদান করে। সমিতিতে যোগদান করার পর সে নিয়মানুযায়ী প্রথমে গ্রামীন ব্যাংক থেকে দশ হাজার টাকা এবং পরবর্তীতে আরও দশ হাজার টাকা সহ মোট বিশ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করে। পরে গ্রামীন ব্যাঙ্ক থেকে আরো ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে এই টাকা খাটিয়ে সে তার বানানো গহনা মিরপুর, ফার্মগেট ও আজিজ সুপার মার্কেটসহ বিভিন্ন দোকানে বাজারজাত শুরু করে এবং বর্তমানে এর থেকে প্রতিমাসে ৩০/৫০ হাজার টাকা রোজগার করছে। এ ছাড়াও সে বায়ু সাইন ও বায়ুটেক নামের একটি ফ্যাক্টরিতে স্বল্প বেতনে কাজও করছে।
জুঁই আক্তার এর বর্তমান
বয়স প্রায় ৩৯ বৎসর। ১৯৮৭ সালে ১ জানুয়ারী বগুড়া জেলার ধুনট থানায় জন্মগ্রহণ করে। সে শৈশবেই পিতৃমাতৃহীন হন এবং কয়েক বছরের ব্যবধানে তাকে তার কয়েকজন আত্মীয় সম্পর্কিত স্বজনদের আশ্রয়ে বেড়ে উঠতে হয়। দুই ভাই-বোন এর মধ্যে জুঁই ছোট। কৈশর পার করার আগেই তার ১৯৯৫ সালে মানিকগঞ্জের ফারুক হোসেন খানের সাথে বিয়ে হয়। বর্তমানে তাদের স্বাধীন হোসেন ও সাকিব হোসেন খান নামে দুটি সন্তান রয়েছে। তার স্বামী একটি লন্ড্রীর দোকান আছে। টানা পোড়েনের সংসারে মাটির হাতের কাজ করে সে আজ স্বাবলম্বী।
তার প্রতিষ্ঠানের নাম “বাংলাদেশের সাজ” জুই বলেন, আমার মাথায় যেই আইডিয়াটা আসে সেটা হলো মাটির জিনিস পত্র। এখন আমার মাসিক আয় ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা।তবে কখনো কখনো এর থেকে কম বেশি হয়। আমার পন্য গুলো শুধু দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়৷ দেশের বাহিরের ক্রেতারা অনলাইনে পন্য অর্ডার দিচ্ছে যে মাস গুলোয় প্রোগ্রাম বেশি থাকে সে মাসে আরো বেশি সেল হয়
। জয়ীতা ফাউন্তাডেশনের সদস্য ও সারাকুঞ্জু বুটিক এর মালিক উদোক্তা দিলশাদ বেগম আলোরযুগকে বলেন,জুঁই আখতার একজন সফল নারী, সে আমাদের মডেল,তার মতো নারী উদ্যোক্তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবসায় এগিয়ে এলেই দেশে নারীর ক্ষমতায়নের কাজটি আরো ত্বরান্তিত হবে।

ছবি: জুই আখতার
