আলোর যুগ বিনোদনঃ এক গোপন ঘরে রাখা আছে সোনায় মোড়ানো এক মুকুট। চারপাশে অন্ধকার, আলো পড়ে কেবল এক জায়গায়—মুকুটের উপর। হীরার ঝলকানিতে যেন চোখ ধাঁধিয়ে যায়। কেউ জানে না এর প্রকৃত মূল্য। শুধু এটুকুই জানা, এটি রাজা তৃতীয় চার্লসের মাথায় উঠেছিল ৬ মে ২০২৩, ব্রিটেনের রাজ্যাভিষেকের দিন। ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবের অভ্যন্তরে সেদিন ছিল যেন রত্নের রাজ্য। রাজা চার্লস যখন সোনার মুকুট মাথায় চাপালেন, তখন বিশ্বের চোখ আটকে গেল সেই মুকুটে—ক্রাউন জুয়েলস। শত শত বছর ধরে ব্রিটিশ রাজপরিবারের ভাণ্ডারে জমা হওয়া এই রত্নসম্ভার শুধু ঐতিহাসিকই নয়, এটি পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত সম্পদগুলোর একটি।
ক্রাউন জুয়েলস বলতে বুঝায় সেই বিশাল রাজমুকুট, রাজদণ্ড, রাজগোলক, আংটি—যা ব্যবহার করা হয় শুধুমাত্র রাজ্যাভিষেকের মতো বিশেষ অনুষ্ঠানগুলোতে। এতে আছে প্রায় ২৩ হাজারের বেশি রত্ন! এমনই তথ্য জানাচ্ছেন রত্ন ইতিহাসবিদ জোসি গুডবডি। তিনি বলেন, এই রত্নগুলোর প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ এক কথায় অসম্ভব। কেউ এগুলো বিক্রি করার কথা ভাবতেই পারে না।
বিমা কোম্পানিগুলো বলছে ভিন্ন কথা। তারা আন্দাজ করেছে, এই সম্পদের ক্ষতিপূরণমূল্য হতে পারে প্রায় ৫ বিলিয়ন পাউন্ড। শুধু একদিনের অনুষ্ঠান—রাজ্যাভিষেকের সময় এগুলো বিমা করতে চাইলে খরচ পড়বে প্রায় ৫১ হাজার পাউন্ড! আর পুরো রত্নভাণ্ডারের জন্য বার্ষিক প্রিমিয়াম গুনতে হবে প্রায় ১৮.৯ মিলিয়ন পাউন্ড।
ক্রাউন জুয়েলসের সবচেয়ে পবিত্র মুকুটটির নাম সেন্ট এডওয়ার্ডস ক্রাউন। এটি তৈরি হয়েছিল ১৬৬১ সালে রাজা দ্বিতীয় চার্লসের জন্য। বর্তমান রাজা তৃতীয় চার্লস এই মুকুট পরে ছিলেন কেবল রাজ্যাভিষেকের মূল মুহূর্তে। ২.০৭ কেজি ওজনের এই মুকুটে শুধুই সোনার দাম দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ ১৭ হাজার পাউন্ড। অথচ এটি অলংকৃত করা হয়েছে হাজার হাজার হীরা, পান্না, মুক্তা, রুবি ও নিলায়।
রাজা যখন রাজ্যাভিষেকের পর অ্যাবে থেকে বের হন, তখন তার মাথায় ছিল অন্য একটি মুকুট—যাতে ২৮৬৮টি হীরা, ১৭টি নীলা, ১১টি পান্না, ২৬৯টি মুক্তা এবং ৪টি রুবি বসানো। কিং চার্লসের সঙ্গে সেই দিন রানি ক্যামিলাও পেয়েছেন তাঁর রাজমুকুট। তিনি পরেছেন কুইন মেরিস ক্রাউন। তৈরি হয়েছিল ১৯১১ সালে, রাজা জর্জ পঞ্চমের রানির জন্য। এই মুকুটেও ছিল ২২০০টি হীরা। তবে বিতর্কিত কোহিনুর হীরা এতে রাখা হয়নি। বদলে বসানো হয়েছে রানি এলিজাবেথের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে নেওয়া কালিনান থ্রি, ফোর ও ফাইভ হীরা। যেগুলো একসময় রানি পরতেন ব্রোচ হিসেবে। সেগুলোর বাজার মূল্য প্রায় ৫ কোটি পাউন্ড!
এমন রত্ন কেবল শোভা পায় রাজার মাথায় নয়, ইতিহাসেও। যেমন রাজদণ্ড—যা প্রথম ব্যবহার হয় চার্লস দ্বিতীয়ের রাজ্যাভিষেকে। সেটি আজও ব্যবহার হচ্ছে। এতে আছে ১.৩২ কেজি সোনা, যার মাথায় বসানো আছে হীরা, রুবি, পান্না ও মুক্তা। তবে প্রশ্ন উঠছে—এতো বিলাসিতা কেন? অনেকের মতে, এমন রাজ্যাভিষেক যেন এক ‘রত্ন প্রদর্শনী’। বিতর্কও তাই থামছে না। কিন্তু ইতিহাস বলছে, রত্ন আর রাজতন্ত্র কখনো আলাদা হয়নি। যেমন ফ্রান্সের রাজতন্ত্রের পতনের পর টিফানির প্রতিষ্ঠাতা কিনে নিয়েছিলেন রাজমুকুটের এক-তৃতীয়াংশ।