Thursday, December 18, 2025
Homeজাতীয়বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা দেওয়ার প্রবণতা ধীরে ধীরে একটি গুরুতর সমস্যায় পরিণত...

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা দেওয়ার প্রবণতা ধীরে ধীরে একটি গুরুতর সমস্যায় পরিণত হয়েছে…..নুরুজ্জামান ফারুকী.

— নুরুজ্জামান ফারুকীর ‘মেডিকপ’ দেবে সুরক্ষা
——————————–
জাভেদ মোস্তফা 🇧🇩
দেশের অনেক মানুষের অভিজ্ঞতা আজ প্রায় একই রকম। সামান্য অসুস্থতা—কয়েক দিন ধরে কাশি, পিঠে ব্যথা, কিংবা সিঁড়ি ভাঙলে হাঁপিয়ে যাওয়া। এই ধরনের সমস্যায় চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পর অনেকেই চেম্বার থেকে বের হন একগাদা পরীক্ষার প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে। প্রথমে বিষয়টি খুব একটা অস্বাভাবিক মনে না হলেও, বিলের হিসাব কষতে গিয়ে অনেকেই চমকে ওঠেন। কয়েক হাজার নয়—খরচ গিয়ে দাঁড়ায় ১৫ হাজার, ২০ হাজার, কখনো কখনো ২৫ হাজার টাকাতেও পৌঁছে যায়।
এই অবস্থায় অনেক রোগীর মনেই প্রশ্ন জাগে—এতগুলো পরীক্ষা কি সত্যিই প্রয়োজন ছিল?
কিন্তু এই প্রশ্নটা বেশিরভাগ সময় উচ্চারিত হয় না। আমাদের সমাজে চিকিৎসকের সিদ্ধান্তকে প্রশ্ন করা অনেকের কাছেই অস্বস্তিকর মনে হয়। কেউ কেউ ভয় পান—প্রশ্ন করলে চিকিৎসক বিরক্ত হবেন কি না, কিংবা চিকিৎসার মানে প্রভাব পড়বে কি না। ফলে সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও বেশিরভাগ রোগী নীরব থাকেন।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা দেওয়ার প্রবণতা ধীরে ধীরে একটি গুরুতর সমস্যায় পরিণত হয়েছে। যে চিকিৎসা পরামর্শ হওয়ার কথা ছিল দ্রুত ও সাশ্রয়ী, তা অনেক সময় রূপ নেয় ব্যয়বহুল পরীক্ষা-নিরীক্ষার দীর্ঘ তালিকায়। এই প্রবণতা শুধু শহরে সীমাবদ্ধ নয়; জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও একই চিত্র দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে রোগী পরীক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য না বুঝেই অর্থ ব্যয় করেন।
অধিকাংশ রোগী কোনো প্রশ্ন না করে বিল পরিশোধ করেন—সঞ্চয় ভেঙে, কিংবা প্রয়োজনে আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার করে। তবে অর্থ পরিশোধের পরও মনে এক ধরনের অস্বস্তি থেকে যায়—সব পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। এই অস্বস্তি ধীরে ধীরে হতাশায় রূপ নেয়, যা চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি করে।
স্বাস্থ্যখাত সম্পর্কে অবগত ব্যক্তিরা সাধারণত দুটি প্রধান কারণের কথা উল্লেখ করেন। একটি হলো ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে কিছু চিকিৎসকের কমিশনভিত্তিক আর্থিক সম্পর্ক, যা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এই কমিশনের অঙ্ক অনেক ক্ষেত্রে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ দাবি করেন। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা থাকলেও, কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি এখনো দুর্বল।
আরেকটি বড় কারণ হলো বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর অভ্যন্তরীণ চাপ। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের কাছ থেকে মাসিক আয়ের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা পূরণের প্রত্যাশা থাকে, যা পরীক্ষার সংখ্যা ও ব্যয়ের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এই কাঠামোগত চাপ চিকিৎসকদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে। ফলে কখনো কখনো এমন পরীক্ষাও প্রেসক্রিপশনে যুক্ত হয়, যেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে অপরিহার্য নয়।
এই প্রবণতার প্রভাব শুধু আর্থিক ক্ষতিতে সীমাবদ্ধ নয়। অনেক মানুষ এখন চিকিৎসকের কাছে যেতে দ্বিধা বোধ করেন, ব্যয়ের আশঙ্কায় চিকিৎসা বিলম্বিত করেন। গ্রামাঞ্চলে এই প্রবণতা আরও প্রকট—অনেকে শেষ পর্যন্ত স্থানীয় ও অপ্রশিক্ষিত চিকিৎসকের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হন। এতে রোগ জটিল হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
যাদের সামর্থ্য রয়েছে, তারা বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার দিকেও ঝুঁকছেন। প্রতিবছর বিপুল অঙ্কের অর্থ—হাজার কোটি টাকারও বেশি—ব্যয় হচ্ছে এমন পরীক্ষায়, যেগুলোর রোগ নির্ণয়ে কার্যকারিতা সীমিত। এই ব্যয় বহন করছে সাধারণ মানুষ। দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়ছে জাতীয় অর্থনীতিতেও।
এই জটিল বাস্তবতার মাঝেই একটি প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগ সামনে এসেছে—মেডিকপ। এটি একটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যের অ্যাপ, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে রোগীদের বুঝতে সহায়তা করে—ডাক্তারের দেওয়া পরীক্ষাগুলোর মধ্যে কোনগুলো চিকিৎসাগতভাবে যুক্তিসংগত এবং কোনগুলো অপেক্ষা করতে পারে।
মেডিকপের মূল দর্শন হলো রোগীকে ক্ষমতায়ন করা। এটি চিকিৎসকের বিকল্প নয় এবং কখনোই নিজেকে সেই জায়গায় দাঁড় করায় না। বরং রোগীকে তথ্য দিয়ে সচেতন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ করে দেয়। আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থায় “second opinion” একটি স্বীকৃত ধারণা, মেডিকপ সেই ধারণাকেই প্রযুক্তির মাধ্যমে সহজ করে তুলছে।
মেডিকপ ব্যবহার পদ্ধতি সহজ। ব্যবহারকারী নিজের উপসর্গ লিখে, লিঙ্গ, উচ্চতা ও ওজনের মতো মৌলিক তথ্য প্রদান করেন এবং প্রেসক্রিপশন বা বিলের ছবি আপলোড করেন। প্রায় ৪৫ সেকেন্ডের মধ্যে অ্যাপটি পরীক্ষাগুলোর একটি ব্যাখ্যামূলক বিশ্লেষণ দেয়—কোন পরীক্ষাগুলো সাধারণভাবে প্রয়োজনীয় এবং কোনগুলো এই মুহূর্তে অপরিহার্য নাও হতে পারে। বিশ্লেষণের সঙ্গে যুক্ত থাকে যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা, যাতে রোগী বিষয়টি বুঝতে পারেন।
এই ধরনের তথ্যভিত্তিক সহায়তা রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যে সম্পর্কের ধরনেও পরিবর্তন আনতে পারে। চিকিৎসা সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে, বরং আলোচনাকে আরও স্বচ্ছ ও তথ্যসমৃদ্ধ করা সম্ভব হয়।
মেডিকপের উদ্যোক্তা নুরুজ্জামান ফারুকী, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সফটটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং একজন এআই গবেষক। তাঁর নামে ৪০টির বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে, রয়েছে একাধিক বই, এবং তিনি গুগল ও আমাজনের মতো প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীদের সঙ্গে গবেষণায় যুক্ত ছিলেন। ২০২৪ সালে তিনি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা গবেষকের স্বীকৃতি পান।
তবে এই উদ্যোগের পেছনে ছিল একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। ফারুকী নিজেই একবার তুলনামূলকভাবে সাধারণ একটি কোলেস্টেরল সমস্যার জন্য প্রায় ২২ হাজার টাকার পরীক্ষার প্রেসক্রিপশন পান। পরে অন্য চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনা করে জানতে পারেন, এর একটি বড় অংশ প্রয়োজনীয় ছিল না। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে ভাবায়—এটা যদি একজন গবেষকের সঙ্গে ঘটে, তাহলে সাধারণ মানুষের অবস্থা কী?
এই প্রশ্ন থেকেই উদ্যোগের সূচনা। প্রায় ২০০ শিক্ষার্থীর সহযোগিতায় তিনি মেডিকপ তৈরি করেন। বর্তমানে অ্যাপটির সব পরিচালন ব্যয় তিনি নিজেই বহন করছেন, যাতে সাধারণ মানুষ বিনামূল্যে এই সেবা নিতে পারেন। উদ্যোক্তার ভাষায়, রোগীর আর্থিক সুরক্ষাই এখানে প্রধান বিবেচ্য।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফারুকীর একটি ভিডিও ব্যাপক সাড়া ফেলে। সেখানে তিনি নিজের অভিজ্ঞতা ও অ্যাপটির কার্যপ্রণালি তুলে ধরেন। কয়েক দিনের মধ্যেই ভিডিওটি ৩৯ হাজারের বেশি মানুষ দেখেন এবং অসংখ্য ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া আসে। অনেকেই মন্তব্যে জানান, চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে তাঁদের দীর্ঘদিনের উদ্বেগ এই উদ্যোগে প্রতিফলিত হয়েছে।
এই প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে দেয়, অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ কতটা গভীর। এটি শুধু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়, বরং একটি কাঠামোগত সমস্যার বহিঃপ্রকাশ।
মেডিকপ যদি আরও বিস্তৃতভাবে ব্যবহৃত হয়, তাহলে এটি রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যে আরও স্বচ্ছ ও ভারসাম্যপূর্ণ আলোচনার সুযোগ তৈরি করতে পারে। এতে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো, রোগীর আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং স্বাস্থ্যখাতে কিছুটা হলেও স্বস্তি আনার সম্ভাবনা রয়েছে। এ লক্ষ্যে উদ্যোক্তা সরকারি সংস্থা, হাসপাতাল এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
একটি অ্যাপ একা স্বাস্থ্যখাতের সব দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। তবে মেডিকপ দেখিয়ে দিয়েছে, সঠিক উদ্দেশ্যে প্রযুক্তির ব্যবহার কীভাবে রোগীর পক্ষে একটি কার্যকর সহায়তা হিসেবে কাজ করতে পারে। চিকিৎসা ব্যয় যখন ক্রমাগত বাড়ছে, তখন রোগীকে তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়াই হতে পারে সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ।

মেডিকপের উদ্যোক্তা নুরুজ্জামান ফারুকী, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সফটটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং একজন এআই গবেষক।

মেডিকাপ লিংক:
https://medicopbd.com/

faruqui.swe@diu.edu.bd

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments