আলোর যুগ প্রতিনিধিঃ নরেন্দ্র মোদির একক আধিপত্যে এবার ভাটা পড়েছে। লোকসভা নির্বাচনে জিতেও তাই মোদির কপালে বড় চিন্তার ভাঁজ। গেল একক দশক তিনি যে দোর্দন্ড দাপট দেখিয়েছেন, এবার সেই উঁচু গলা কিছুটা হলেও নীচু হবে। কারণ, লোকসভায় যে একক দাপট মোদির দল এতোদিন দেখাতো বিরোধীদের থোরাই কেয়ার করে। এবার সেই পথ মোটেও মসৃণ রইলো না মোদির জন্য।
মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নিজেদের ‘নতুন ভারতের’ প্রতিনিধি দাবি করে আসছে। কংগ্রেসকে ইঙ্গি করে তারা দাবি করে আসছে, তাদের হাতের বর্তমান ভারত স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতিমুক্ত। বিপরীতে মোদি প্রশাসনের বিরুদ্ধে আছে কট্টরপন্থা ও রাজনীতিকে চূড়ান্ত ধর্মীকরণের অভিযোগ। এবার ভোটের ফল বুথ ফেরত জরিপেরও মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে।
বুথ ফেরত ফলাফলে তিন শতাধিক আসন পাওয়া মোদির দল পেয়েছে ২৪০ আসন। জোট শরিকদের দুয়ারে করজোর করা ছাড়া তাদের কোনো উপায় নাই। শরিকদের সায় পেয়ে মোদি সরকার গঠনের তোড়জোর শুরু করেছেন ঠিকই। তবে তার সামনে আছে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ।
এ হুমকির বাইরে আগামী সরকার গঠন নিয়ে চলা রাজনৈতিক আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ এক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন বিশ্লেষক ও রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আর সেটি হলো, শরিকদের কাঁধে ভর করে চলা ভবিষ্যৎ সরকার পরিচালনা করতে পারবেন তো মোদি? যা আগে কখনোই করেননি তিনি।
নয়াদিল্লির গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের (সিপিআর) রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নীলাঞ্জন সরকার এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘এটি অজানা।’ তিনি আরও বলেন, ‘মোদি শুধু নিরঙ্কুশ কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা নিয়ে কাজ করা একজন নেতা হিসেবেই পরিচিত।’ এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, ‘“মোদি সরকার” এক বিশেষ ধরনের শাসনব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। শরিকদের সঙ্গে সমঝোতা করা বা বিক্রি হয়ে যাওয়া মোদি আমাদের কাছে পরিচিত নন।’
নির্বাচনি ফল ঘোষণার পর বিজেপি সদর দপ্তরে দলের সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন নরেন্দ্র মোদি। এ সময় বিহারে ক্ষমতাসীন জোটের বড় জয়ের পেছনে জেডি (ইউ) নেতা নীতীশ কুমারকে কৃতিত্ব দেন তিনি। যদিও দুই নেতা দীর্ঘদিন ধরেই ‘ভালোবাসা-ঘৃণার’ উত্থান–পতনের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে গেছেন। কখনো এ সম্পর্কে ছেদ ঘটেছে, কখনোবা জোড়া। নীতীশের দল এবার ১২টি আসন পেয়েছে।
জেডির (ইউ) মতো টিডিপিকেও বিজেপি ও কংগ্রেস উভয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় লুকোচুরি খেলতে দেখা গেছে। জেডি (ইউ) ও টিডিপি দুই-ই ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবমূর্তি ধরে রেখেছে, মুসলিম ভোটারদের সমর্থন গুরুত্ব দিয়েছে ও বিজেপির হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতি থেকে নিজেদের দূরে রেখেছে; যেটি মোদির বিজেপির আদর্শের বিপরীত। নির্বাচনে টিডিপি পেয়েছে ১৬টি আসন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, মোদিকে একজন শক্তিশালী, ফলাফল নির্ধারণকারী নেতা হিসেবে সফলভাবে তুলে ধরতে পেরেছে বিজেপি; যিনি রাজনীতিকে স্বাভাবিক নীতিতে চলতে দেননি। এটি সম্ভব হয়েছে কারণ, মোদিকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়া কখনো শাসনকাজ চালাতে হয়নি। ২০০১ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর জাতীয় পর্যায়ে প্রথম বিশেষ পরিচিত পান মোদি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে এ রাজ্য ১৩ বছর শাসন করেছেন তিনি। গুজরাট কিংবা জাতীয় পর্যায়, সবখানে উপভোগ করেছেন একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবিধা।
‘নির্বাচনী ফলাফলে ‘‘ব্র্যান্ড মোদি’ ও ‘বড় রকম ধাক্কা খেয়েছে’, বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক রশিদ কিদওয়াই। আবার এ ফলাফল সরকার গঠনে মোদির ওপর তৈরি করেছে ‘জোট রাজনীতির’ চাপ। এটি মোদির ‘নতুন ভারত’কে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে ২০১৪ সালের পূর্ববর্তী সময়ে; যখন ভারতে জোট সরকার ছিল একটা স্বাভাবিক ঘটনা।
কিদওয়াই বলেন, ‘জোট সরকারের চাপ মোকাবিলা করা মোদির জন্য কঠিন হবে। কেননা শরিকদের থাকবে নানা প্রত্যাশা। এর মধ্যে সরকারে গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়া একটি।’ বিভিন্ন বিষয়ে মোদির দর–কষাকষি ক্ষমতায়ও নতুন জোট সরকার পরীক্ষা হয়ে দাঁড়াবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।বিজেপির বিরুদ্ধে তার শত্রু-মিত্র উভয়ের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টির অভিযোগ সমালোচকদের। যেমন মিত্র শিবসেনা ও বিরোধী ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি। মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে দুই দলই গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক।
সিপিআরের নীলাঞ্জন সরকার বলেন, শরিকদের দাবি অনুযায়ী মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদ দিয়ে তাদের সন্তুষ্ট রাখার কাজ নরেন্দ্র মোদিকে চালিয়ে যেতে হবে। যদিও মন্ত্রিসভার পদই সরকারে যথেষ্ট কিছু নয়।
আর মোদির জীবনীকার নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘জোট সরকারকে ঠিক রাখতে শরিকদের যথেষ্ট দাবিদাওয়া মেটাতে হবে মোদিকে। গত ১০ বছর তিনি যেভাবে দেশ শাসন করে গেছেন, সেভাবে চলতে গেলে তাঁর সামনে এর কোনো বিকল্প নেই, তাঁকে তাঁর দপ্তর খোলা রাখতেই হবে।’
‘মোদিকে এমন এক ব্যক্তি হতে হবে, যিনি হবেন বিনয়ী ও অন্যদের সঙ্গে কাজ করার জন্য খোলা মনের অধিকারী, যে রূপে আমরা তাঁকে কখনো দেখিনি’, বলেন নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়।