আলোর যুগ প্রতিনিধিঃ ‘গত কদিনের মৃত্যুর ঘটনা দুঃখজনক। কোটাবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ও মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় আমরা লজ্জিত। সংবিধান ও আইনে সব বিষয় লেখা আছে। কিন্তু আমরা কেউই সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করছি না। পুলিশ কি আচরণ করবে তাতো সিআরপিসিতে পরিস্কার বলা আছে।’ মঙ্গলবার বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না চালানোর এবং তথাকথিত নিরাপত্তার নামে হেফাজতে নেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের দ্রুত মুক্তির নির্দেশনা চেয়ে করা রিটের শুনানির সময় এ মন্তব্য করেন। হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিটটি করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন এবং আইনুন্নাহার সিদ্দিকা।
আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সরাসরি তাজা গুলির ব্যবহার কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না এবং তাজা গুলি ব্যবহার না করার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, জানতে রুল চাওয়া হয়েছে রিটে। সেই সঙ্গে তথাকথিত নিরাপত্তার নামে হেফাজতে নেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের দ্রুত মুক্তি দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, রিটে সে মর্মেও রুল চাওয়া হয়েছে। শুনানিতে প্রথমে আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন বলেন, আন্দোলনকারীদের ওপরে অবাধে গুলি ছুড়া হচ্ছে। বিবিসি, আল জাজিরাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ভিডিও ফুটেজ আছে। আমাদের সেনাবাহিনী মাত্র ২০ গজ দূরত্ব থেকে ব্রাশ ফায়ার করেছে। আন্দোলনকারীদের হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ১৪৭ জনের মুত্যৃ হয়েছে। সরকারি বাহিনীগুলো ছিল সশস্ত্র। বিপরীতে আন্দোলনকারীরা ছিল নিরস্ত্র। গত কয়েক দিনের ভিডিও ফুটেজ আমরা দিতে পারবো।
হাইকোর্ট তখন বলেন, বিবিসি বাংলাসহ অনেক বিদেশি মিডিয়ায় নিউজ বিকৃত করে প্রচার করেছে। সুতরাং ওইসব নিউজ আসলে অকাট্যভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। মানজুর বলেন, স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই ১৪৭ জনের মৃত্যুর কথা বলেছেন। এছাড়া দেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম দুই শতাধিক মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেছে। সেসবের ভিডিও ফুটেজ আছে। ভিডিও ফুটেজগুলো কিভাবে অস্বীকার করবেন? এ সময় আন্দোলন চলাকালে বিভিন্ন শিশুর মৃত্যুর কথা তুলে ধরে মানজুর বলেন, একটি শিশু ছাদে খেলতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। হাইকোর্ট তখন বলেন, এর দায় কার? মানজুর বলেন, নিঃসন্দেহে এটা সরকারের দায়। হেলিকপ্টার থেকে গুলি করার কোনো সুযোগ নাই। ৬ জন সমন্বয়কারীকে ডিবি তুলে নিয়ে গেছে। ডিবি বলছে, তাদের নিরাপত্তার জন্যেই তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাহলে তাদের দিয়ে বিবৃতি দেওয়ানো হলো কিভাবে? এখানে সবাই বাংলাদেশের মানুষ। কেউ পাঞ্জাব থেকে আসেনি।
হাইকোর্ট তখন বলেন, এখানে অনেক রাজনৈতিক বিষয় জড়িত আছে। সুতরাং কোর্ট যাতে বিতর্কিত না হয়। এরপর আইনজীবী অনীক আর হক শুনানিতে দাঁড়িয়ে বলেন, আমাদের আরজি হলো তাজা গুলি ছোঁড়া বন্ধ করা। তাতে প্রাণ রক্ষা হবে। দেশের সম্পদ নষ্ট হচ্ছে সেটাও আমরা চাই না। কিন্তু যারা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন, তাদের অধিকাংশেই বয়সে তরুণ। তারাও দেশের সম্পদ। অবশ্যই যাতে তাজা গুলি বন্ধ করা উচিত। আমরা আর একটিও প্রাণহানি চাই না। এরা তো আমাদেরই সন্তান। আন্দোলন দমন করার আরও অনেক উপায় আছে।
শুনানিতে সারা হোসেন বলেন, যাদের তুলে নেওয়া হয়েছে বলা হচ্ছে তাদের নিরাপত্তার জন্য তুলে নেওয়া হয়েছে। গোয়েন্দা শাখা বলছে তাদের গ্রেফতার বা আটক করা হয়নি। তাদের হেফাজতে আছে। কিন্তু সংবিধানে এমন কোনো সুযোগ নাই। এমনকি কোনো আইনেও নাই। তাহলে তাদের কেন কোনো আদালতে হাজির করা হচ্ছে না বা ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে না। এটা কোনোভাবেই গ্রেফতার না। তাহলে এভাবে আটক রাখার ক্ষমতা তারা কোথায় পেল? নিরাপত্তার স্বার্থে কাউকে তুলে নেওয়া যায় এটা কোথায় আছে? গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়া কাউকে তুলে নেওয়ার কথা কোথায় আছে? আমরা কখনো এই ধরনের পরিস্থিতি মুখোমুখী হইনি। এই ৬ জনের রিলিজ করাতে চাই।
জেড আই খান পান্না বলেন, আজকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে যা হচ্ছে তা মেনে নেওয়া যায় না। আদালত তখন বলেন, কোটার সমস্যা তো আপিল বিভাগে সমাধান হয়েছে। পান্না বলেন, সমস্যার তো সমাধান হয়নি। একাত্তর সালে দরজায় নক করে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজা হতো। এখন রাতের আঁধারে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ব্লক রেইড দেওয়া হচ্ছে। দরজায় নক করে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে ছাত্র আছে কিনা। তাদের মোবাইল কেড়ে নিয়ে চেক করা হচ্ছে। এটা কি আইন সঙ্গত? রাষ্ট্রপক্ষে প্রথম শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাছান চৌধুরী। তিনি বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিভাবে আইনের প্রয়োগ করবে, সেটা তাদের নিজস্ব বিষয়। যারা রিট আবেদন নিয়ে এসেছে তারা নিশ্চয়তা দিতে পারবে আর বিটিভি, সেতু ভবন, মেট্রোরেলে হামলা হবে না? নরসিংদীর জেলে হামলা হয়েছে। সেখানের বন্দিরা পালিয়েছে। এটা কিসের ইঙ্গিত?
তখন আদালত বলেন, এ ঘটনার আগে মিছিলে একটি ছেলে গুলি খেয়ে মারা গেছে। তারপর এই ঘটনা ঘটেছে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে একটা মব গিয়ে সেখানে হামলা হয়েছে। মেহেদী হাছান বলেন, দেশে যদি মব হয় সেখানে কি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইন প্রয়োগ করতে পারবে না? যারা মারা গেছে তাদের মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। পুলিশ যদি বেআইনিভাবে গুলি করে থাকে তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, প্রতিটি ঘটনার তদন্ত হবে। এই রিট আবেদনের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। আমরা দেখতে পেয়েছি যে, ডিবি অফিসে ৬ জন কাটা চামচ দিয়ে খাচ্ছে। তখন আদালত বলেন, জাতিকে নিয়ে মশকরা করবেন না। যাকে খুশি ধরে নিয়ে গিয়ে খাবার টেবিলে বসিয়ে দেন, ছবি তুলে আবার সেটি প্রচার করেন।
মেহেদী হাসান বলেন, ওই ৬ জনের পরিবারের সদস্যরা তো আসেনি। অনীক আর হক বলেন, আজকে এটা মৌখিক আদেশ দেন। আদালত তখন বলেন, মৌখিক আদেশে তো কোনো কাজ হবে না। আপনার একটা মৌখিক আদেশ অনেক বড় একটি বার্তা দিবে। অনেক প্রাণ বাঁচবে। এ পর্যায়ে অতিরিক্তি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ বলেন, দুই পক্ষেই হতাহত হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবৈধ উপায়ে বল প্রয়োগ করেছে, এই বিষয়টি আবেদনে কোথাও বলা নেই। তারা ভিত্তিহীন ধারণার ওপর আবেদনটি নিয়ে এসেছে।
আদালত তখন বলেন, যদি ওই ৬ ছাত্রকে আটক না করে থাকেন তাহলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করেন। মোরশেদ বলেন, তাঁদের পরিবার কি বলছে সেটি দেখতে হবে। ডিবি বলেছে তাদের নিরাপদত্তার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ২০০ লোক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে মারা গেছে, এটার প্রমাণ কি? আজহারুল ইসলাম বলেন, আমরা দেশে শান্তি চাই। সহিংস পরিস্থিতি চাই না। আজকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দোলন নেই। তারপরও আন্দোলন হচ্ছে। বাংলাদেশের সংবিধান, আইন এবং সার্বিক বিবেচনা করে একটি আদেশ দেওয়া প্রয়োজন।