আলোর যুগ প্রতিনিধিঃ ভারতের নতুন সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে টানা তৃতীয়বারের মতো শপথ নেওয়া নরেন্দ্র মোদি ও কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি রবিবার সন্ধ্যায় শপথ অনুষ্ঠানের পরপরই একান্ত বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে। গতকাল ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেওয়ার আগে শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর হোটেল কক্ষে এসে সাক্ষাৎ করেন কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী, তার ছেলে রাহুল গান্ধী ও কন্যা প্রিয়াঙ্কা গান্ধী।
নতুন সরকারের সূচনাতেই ভারতের প্রধান দুই নেতার সঙ্গে শেখ হাসিনার সঙ্গে কী কথা হলো তা নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে। অবশ্য তিন দিনের নয়াদিল্লি সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি ও সোনিয়া গান্ধীর বাইরে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি রনিল বিক্রমাসিংহে, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী দাশো শেরিং তোবগে, বিজেপির জ্যেষ্ঠ নেতা লাল কৃষ্ণ আদভানি, ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক ও সাক্ষাৎ করেন। সফর শেষে গতকাল বিকালে নয়াদিল্লি থেকে রওনা দিয়ে সন্ধ্যায় ঢাকা ফেরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ভারত সফরে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, শপথ অনুষ্ঠান শেষে রবিবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎ করেন। অত্যন্ত উষ্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে রাষ্ট্রপতি ভবনে দুই সরকারপ্রধানের বৈঠক হয়েছে। এ সময় তিনি নরেন্দ্র মোদি এবং এনডিএ জোটকে নির্বাচনে বিজয়ের জন্য আবারও অভিনন্দন জানান এবং প্রধানমন্ত্রী মোদিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। এ সাক্ষাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই দেশের বন্ধনকে আরও দৃঢ় করতে নরেন্দ্র মোদির নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। নরেন্দ্র মোদিকে সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান শেখ হাসিনা।
ড. হাছান মাহমুদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উন্নীত হয়েছে এবং নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক কাজের সুযোগ রয়েছে। মানুষে মানুষে সংযোগ বৃদ্ধিতে যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নসহ উভয় দেশের আরও উন্নয়নে একসঙ্গে কাজ করে যেতে হবে বলে মনে করেন দুই নেতা। এক প্রশ্নের জবাবে হাছান মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বহুমুখী সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে অনেক বিষয় জড়িত। যেহেতু উভয় সরকার দেশ পরিচালনায় অব্যাহত রয়েছে, সেহেতু একসঙ্গে কাজ করার কিছু সুবিধা আছে। দুই দেশের জনগণ বিভিন্ন দিক থেকে উপকৃত হচ্ছে। আমাদের বহুমাত্রিক সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও সম্প্রসারিত এবং গভীর হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, গতকাল সকালে রাজধানী নয়াদিল্লির আইটিসি মৌর্য হোটেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি রনিল বিক্রমাসিংহের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সাক্ষাতের পরই ভারতের ইউনিয়ন মন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতে দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ হয়েছে। সে দেশের চরম অর্থনৈতিক ক্রান্তিকালে বাংলাদেশের সহায়তার জন্য রনিল বিক্রমাসিংহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান। কৃষি খাতে বাংলাদেশের প্রযুক্তি এবং পর্যটন খাতে শ্রীলঙ্কার দক্ষতা ও বিনিয়োগ সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের ইউনিয়ন মন্ত্রী এস জয়শঙ্করের বৈঠকটিও হৃদ্যতাপূর্ণ ছিল উল্লেখ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে এস জয়শঙ্করের আন্তরিকতার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে পুনরায় মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হওয়ায় অভিনন্দন জানান ও একসঙ্গে কাজ করার ইচ্ছার কথা জানান। শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি রনিল বিক্রমাসিংহে এবং ভারতের ইউনিয়ন মন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান।
পরে বিকালে আইটিসি মৌর্য হোটেলে সাক্ষাৎ করেন ভারতের পার্লামেন্টের রাজ্যসভা সদস্য ও কংগ্রেস পার্লামেন্টারি পার্টির চেয়ারপারসন সোনিয়া গান্ধী, তার ছেলে ও লোকসভার বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধী ও ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। ভারতের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারের প্রভাবশালী তিন সদস্য কংগ্রেস নেতা সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর সঙ্গে অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ ও আন্তরিক পরিবেশে শেখ হাসিনার সৌজন্য বিনিময় করার খবর দিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। ভারতের সাংবাদিকদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে হৃদ্যতাপূর্ণ শুভেচ্ছা বিনিময়ের ছবি। হিন্দুস্তান টাইমস লিখেছে, শেখ হাসিনা ও গান্ধী পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের ইতিহাস তাদের পূর্বপুরুষদের হাত ধরে তৈরি। শেখ হাসিনার পিতা বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর খুবই আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার বাংলাদেশের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে; যা দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও শ্রদ্ধাবোধের দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তি তৈরি করে দেয়। তাই গান্ধী পরিবার সরকারের কোনো পদে থাকুক বা না থাকুক শেখ হাসিনার সফরে সাক্ষাৎ হয় প্রায় প্রতিবারই।
ভারতের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভার ১৮তম নির্বাচনে বিজয়ী এনডিএ জোটের নেতা নরেন্দ্র মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার বিকালে দিল্লি পৌঁছান। রবিবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) জ্যেষ্ঠ নেতা লাল কৃষ্ণ আদভানির সঙ্গে তার বাসভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। প্রধানমন্ত্রী এ সময় ৯৬ বছর বয়সি এল কে আদভানির সঙ্গে পূর্বস্মৃতিচারণা ও ব্যক্তিগত আলাপ করেন। এদিন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী দাশো শেরিং তোবগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে হোটেলে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এ সময় শেখ হাসিনা ভারতের মধ্য দিয়ে ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে বাংলাদেশের আগ্রহের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন ও এজন্য প্রয়োজনীয় ত্রিপক্ষীয় চুক্তি নিয়ে ইতোমধ্যে ভারতের সঙ্গে আলোচনার কথা জানান। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে প্রস্তুত থাকার কথা জানিয়ে তার দেশে বার্ন ইউনিট নির্মাণ এবং এক বছরের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দেন।
রবিবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি ভবনে সারা বিশ্ব থেকে আগত প্রায় ৮ হাজার অতিথির সঙ্গে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর কন্যা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক সায়মা ওয়াজেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন। গতকাল বিকালে দিল্লির বিমান বাহিনীর বিশেষ বিমানবন্দর থেকে রওনা হয়ে সন্ধ্যায় হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।