আলোর যুগ প্রতিনিধিঃ বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের পর এখন পর্যন্ত সিরিয়ায় পাঁচ শতাধিক হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। দেশটির সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দেশ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক পর্যবেক্ষক সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস এ তথ্য দিয়েছে। ইসরায়েল সবশেষ লাতাকিয়া ও তারতাসের একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে।
এমনকি জাতিসংঘের আপত্তি কানে না তুলে ইসরায়েলের সেনারা বাফার জোন (সংঘাতের প্রভাব এড়াতে বিশেষ অঞ্চল) পেরিয়ে সিরিয়ার ভূখণ্ডেও প্রবেশ করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইসরায়েল কেন এখন আবার সিরিয়ায় হামলা শুরু করল? এর নেপথ্য কারণ হিসেবে ইসরায়েল বলছে, তাদের লক্ষ্য হলো দেশটির সামরিক বাহিনীর সামরিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করা। তারা চাচ্ছে, সিরীয় বাহিনীর অস্ত্রগুলো যেন ‘চরমপন্থীদের’ হাতে না পড়ে।
ইসরায়েলের দাবি, তারা সিরিয়ার বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা, অস্ত্রাগার, গোলাবারুদ সংরক্ষণাগার, বিমানবন্দর, নৌঘাঁটি ও গবেষণাকেন্দ্র লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। সিরিয়া ও ইসরায়েলকে আলাদা করা গোলান মালভূমিসংলগ্ন বাফার জোনেও সেনা মোতায়েন করেছে তারা। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের অস্ত্রবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে এই বাফার জোনকে নিরস্ত্রীকরণ অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।
গোলান মালভূমির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই ইসরায়েলের দখলে। বাশারের পতনের পর বাফার জোনের ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাও তারা দখলে নিয়েছে। গোলান মালভূমির অবশিষ্ট এলাকার নিয়ন্ত্রণ সিরিয়ার কাছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, গোলান মালভূমি-সংলগ্ন সিরিয়ার যেসব অঞ্চল ১৯৭৪ সাল থেকে নিরস্ত্রীকরণ অঞ্চল ছিল, সেগুলো ‘চিরদিনের জন্য’ ইসরায়েলের অংশ হিসেবেই থাকবে।
তবে সিরিয়ায় হামলার পেছনে ইসরায়েলের উদ্দেশ্য কী, তা এখনো স্পষ্ট নয়। ইসরায়েল সরকার শুধু বলেছে, তারা ‘ইসরায়েলের প্রতিরক্ষার স্বার্থে’ কাজ করছে। এর বাইরে এমন কিছু বলেনি যা থেকে সিরিয়া ঘিরে দেশটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যদিও এ নিয়ে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি সিরিয়ার। মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে পরিচালিত ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডেভিড ডেস রোচেস বলেছেন, ইসরায়েল সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্রের মজুদকে লক্ষ্যবস্তু করেছে। কারণ সে তার নিরাপত্তার বিরুদ্ধে যেকোনো হুমকি দূর করতে চায়।
আরব উপদ্বীপ বিষয়ক পেন্টাগনের সাবেক এই পরিচালক আরও বলেন, ‘২০১৩ সালে ফ্রান্স সরকারের করা এক হিসেব মতে, সিরিয়ায় প্রায় ১ হাজার টন রাসায়নিক অস্ত্র ছিল। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে এসব রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংসের কথা ছিল। সিরীয়রা ২০১৪ সালে জানায়, এগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে। কিন্তু তারা ২০১৭ ও ২০১৮ সালে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর রাসায়নিক হামলা চালায়।’ তবে এই মুহুর্তে সিরিয়ায় কত রাসায়নিক অস্ত্র রয়েছে, সে ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে পারেননি বিশ্লেষক রোচেস। তিনি আরও জানিয়েছেন, ইসরায়েল সিরিয়ার বিমান বাহিনী ও দেশটির ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার ওপর হামলা চালাচ্ছে।
তার কথায়, ‘এর ফলে এখন সিরিয়ার মরুভূমি থেকে আইএসের মতো জঙ্গি গোষ্ঠী বের হলেও তাদের রাসায়নিক অস্ত্র সরবরাহ করার ক্ষমতা থাকবে না। এবং এর পেছনে একটা অনিশ্চয়তাও কাজ করছে। ইসরায়েলিরা জানে না, সিরিয়ায় কেমন সরকার হতে চলেছে। মূলত তারা তাদের কোনো সুযোগ দিতে চায় না।’
তবে কেউ কেউ ইসরায়েলের এই বেপরোয়া বিমান হামলাকে সিরিয়ার সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন হিসেবে দেখছেন। লন্ডনভিত্তিক চিন্তন প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের মিডল ইস্ট অ্যান্ড নর্থ আফ্রিকা কর্মসূচির পরিচালক সানাম বাকিল রয়টার্সকে বলেন, ‘সিরিয়ার অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিচ্ছে ইসরায়েল। এটা অবশ্যই সিরিয়ার সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চুপ থাকা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের কারণে তারা এই সুযোগ নিচ্ছে।’ বাকিল আরও বলেন, ‘নিজেদের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে আরব ভূখণ্ড ব্যবহার করে ইসরায়েল যেভাবে কথিত নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তুলছে, তাতে আরব রাষ্ট্রগুলো অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে।’