আলোর যুগ প্রতিনিধিঃ রাশিয়া ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেদ করে নজিরবিহীন হামলা চালাচ্ছে। বিশেষ করে ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অবকাঠামোকে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়ার এই পরিবর্তিত কৌশল ইউক্রেনকে নতুন করে কঠিন পরীক্ষার মুখে ফেলতে পারে।
গত ১০ই অক্টোবর ভোরে কিয়েভের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে রাশিয়া ড্রোন হামলা চালায়। এতে একটি দৈত্যাকার ট্রান্সফরমার সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। স্থানীয় বাসিন্দা মাইকোলা স্বিরিডেঙ্কো বলেন, মেরামত করার মতো কিছুই অবশিষ্ট নেই। এই হামলায় ৪৬৫টি ড্রোন ও ৩২টি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
গত বছরগুলোতেও শীতকাল থেকেই রাশিয়া ইউক্রেনের জ্বালানি অবকাঠামোতে আঘাত হানার চেষ্টা করে আসছে। তবে সাম্প্রতিক হামলাগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সঞ্চালন কেন্দ্র, হিটিং স্টেশন, এমনকি প্রাকৃতিক গ্যাসের খনি, পাইপলাইন এবং ভূগর্ভস্থ জলাধারগুলোকেও লক্ষ্যবস্তু করছে।
এই আক্রমণের ফলে প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষের শহর কিয়েভের বেশিরভাগ অংশ দিনের একটা বড় সময় বিদ্যুৎ ও জলের সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। প্রথমবার কিয়েভের একটি পাতাল রেল লাইনও কয়েক ঘণ্টার জন্য বন্ধ ছিল, যা শহরের যান চলাচলকে অচল করে দেয়।
ইউক্রেনের জ্বালানি মন্ত্রী মাইকোলা কোলেসনিক নিশ্চিত করেছেন, রাশিয়া এখন ইচ্ছাকৃতভাবে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ কেন্দ্রগুলোতে হামলা চালাচ্ছে। তিনি জানান, শত্রু থামবে না… শুধু অক্টোবরের শুরুতেই আমরা ছয়টিরও বেশি আঘাত দেখেছি। এটি চলতেই থাকবে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ইউরোপ থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
আক্রমণের মূল লক্ষ্য হলো আসন্ন তীব্র শীতে লক্ষ লক্ষ বেসামরিক মানুষকে প্রতিরক্ষাহীন করে তোলা। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে এই শীতে অস্বাভাবিক ঠান্ডা এবং প্রচুর তুষারপাতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়া প্রতিটি হামলায় শত শত ড্রোন ব্যবহার করছে, যার বেশিরভাগই উন্নত করা হয়েছে। এই ড্রোনগুলো আরও দ্রুত উড়তে পারে, উচ্চতর উচ্চতায় যেতে পারে এবং নির্ভুলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে তীক্ষ্ণ কোণে নামতে পারে। ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকেও সফটওয়্যার আপডেটের মাধ্যমে তাদের গতিপথ থেকে বিচ্যুত করে পশ্চিমা-সরবরাহকৃত উন্নত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে, এমনকি মার্কিন তৈরি প্যাট্রিয়টকেও বিভ্রান্ত করার কৌশল নিয়েছে রাশিয়া।
লন্ডন-ভিত্তিক সেন্টার ফর ইনফরমেশন রেজিলিয়েন্স-এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই পরিবর্তনের ফলে ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকানোর হার নাটকীয়ভাবে কমে গেছে। আগস্টে যা ছিল ৩৭ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে তা নেমে এসেছে ৬ শতাংশে। এই সমস্যা আরও বাড়িয়ে তুলেছে ইউক্রেনের অবকাঠামো সুরক্ষার ক্ষেত্রে দুর্নীতি। আগস্ট মাসের শুরুতে ইউক্রেনের দুর্নীতি দমন সংস্থাগুলো ড্রোন-বিরোধী স্থাপনার ব্যয় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেখানোর বিশাল দুর্নীতি ঘটনা ফাঁস করে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই দুর্নীতি ইউক্রেনের জ্বালানি অবকাঠামো রক্ষায় ব্যর্থতাকেই তুলে ধরেছে। জার্মানির ব্রেমেন ইউনিভার্সিটির গবেষক নিকোলাই মিত্রোখিনের মতে, তিন বছরের মধ্যে [অবকাঠামো] মাটির নিচে না রেখে, তারা এর চারপাশে বালির বস্তা রেখেছিল। যা অর্থহীন। কিন্তু তারা জমকালো ড্রোন ইন্টারসেপ্টর-এর নামে তহবিল চুরি করেছে।
এর ফলে, জ্বালানি অবকাঠামো এখন প্রায় ভেঙে পড়ার মুখে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রকৌশলী আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, ধ্বংসের মাত্রা দেখে মনে হচ্ছে, যা ধ্বংস হচ্ছে তা আমরা সহজে মেরামত করতে পারব না। আমাদের সামনে খুব কঠিন একটি শীত আসছে। কিয়েভের বাসিন্দারা অবশ্য বিদ্যুৎ এবং তাপের ঘাটতির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তারা পেট্রোলের ক্যানিস্টার, পাওয়ার ব্যাঙ্ক, ব্যাটারিচালিত কম্বল, বিভিন্ন ধরনের রিচার্জেবল বাতি কিনছেন। এমনকি অনেকে ফায়ার সার্ভিসের বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে নিজেদের অ্যাপার্টমেন্টে কাঠের চুলাও বসাচ্ছেন।
স্থানীয়রা বলছেন, তারা প্রস্তুত। দুই সন্তানের জননী করোটিচ বলেন, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তিন বছর আগের মতো এবার আমাদের বিস্মিত করতে পারবেন না। গ্যাস স্টেশনে কর্মচারীরা এখন তেল বা পেট্রোল ভরার সময় সহজেই জার বা ক্যানিস্টার বুঝে নিয়ে তা পূরণ করতে সাহায্য করছেন। শরমা বিক্রেতা আরসলান আতামুরাদভ জানান, তিনি এখন বিদ্যুতের পরিবর্তে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করছেন তার গ্রিল চালানোর জন্য। তিনি বলেন, আমরা সবকিছু গ্যাসে চালাই। অন্যথায় আমাদের খরচ দ্বিগুণ হয়ে যায়।