ডা:এনামুর রহমান
জাভেদ মোস্তফা 🔊
দীর্ঘ ৭ মাস আত্মগোপনে থেকে অবশেষে ৫ জনকে ক্রস ফায়ারে হত্যা সহ জুলাই-আগস্ট ছাত্র জনতা হত্যার ১১ টি হত্যা মামলার আসামী সাবেক দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান গ্রেপ্তার হয়েছেন।এর আগে আজ সোমবার সকালে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) রোববার মধ্য রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করার পর দুপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন রাজধানীর মিরপুরে হকার সাগর হত্যা মামলায় আদালতে নেয়ার পর তাকে ৬ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
এসময় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের উপ-পরিদর্শক মো. মনিরুল ইসলাম তার দশ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। আসামি পক্ষের আইনজীবী তার রিমান্ড বাতিল ও জামিন চেয়ে শুনানি করেন। অপরদিকে রাষ্ট্র পক্ষে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন।
উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জশিতা ইসলাম তার জামিন নামঞ্জুর করে রিমান্ডের এ আদেশ দেন।ডা: এনামুর রহমান এর আগে ৫ জনকে ক্রস ফায়ারে হত্যা সহ জুলাই-আগস্ট ছাত্র জনতা হত্যার ১৩ টি মামলার আসামী ।
তিনি দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদে ঢাকা-১৯ আসন থেকে নির্বাচিত হন। তিনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালালেয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। এনামুর এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। এমপি থাকা কালিন তার বিরুদ্ধে মৃত মানুষের লাশ আটকে রেখে টাকা আদায় ও ক্রসফায়ারে মানুষ হত্যা অভিযোগ রয়েছে। যা তিনি নিজেই স্বীকার ২০১৭ সালে বক্তব্য দিয়েছিলেন। এর জন্য আওয়ামী লীগ সরকার পুরস্কার হিসেবে তাকে মন্ত্রীত্বের আসনে বসিয়েছিল। তিনি ত্রান প্রতিমন্ত্রী থাকা কালিন সাভারে কোন ত্রান দেন নাই। করোনার সময় একাধিক আওয়ামী লীগের নেতারা ত্রান দিলেও তিনি বলতেন, সাভারের মানুষ বড় লোক, তাদের ত্রান লাগে না।এহেন কার্যকলাপে তিনি বিগত সংসদ নির্বাচনে তিন জন আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দির মধ্যে লজ্জাজনক ভাবে তৃতীয় স্থান লাভ করেন। তিনি জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ে মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে ছাত্র জনতার ওপর গুলি বর্ষন করিয়ে সাভার আশুলিয়ায় ত্রাসের রাজত্বে কায়েম করেন। তার বিরুদ্ধে ১১ টি হত্যা মামলা সহ কয়েকটি হত্যা চেষ্টা মামলা রয়েছে। পুলিশকে ম্যানেজ করে তিনি ইতি মধ্যেই দুই টি হত্যা মামলা থেকে অব্যহতি নিয়েছেন বলে জানা গেছে। ৫ আগস্ট পালোনোর পর তার তৃতীয় স্ত্রী ডা: ফরিদা ইয়াসমিন প্রচার চালান তিনি ভারতের কাশমীরে ছোট ছেলের শুশুর বাড়ীতে অবস্থান করছেন। কিন্তু তিনি পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে ঢাকাতেই অবস্থান করছিলেন এবং তার সাঙ্গপাঙ্গ সহ ৪ স্ত্রী ও পরিবারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলেন।
ডা.এনামুর রহমান সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা। রাজনীতিতে তার অভিষেক হয় ২০১৪ সালে। ওই বছর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ঢাকা-১৯ আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও একই আসন থেকে জয়লাভ করেন।
২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি শেখ হাসিনার চতুর্থ মন্ত্রিসভায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি নৌকা প্রতীক নিয়ে অংশ নেন। তবে, স্বতন্ত্র প্রার্থী সাইফুল ইসলামের কাছে পরাজিত হন।
গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর এনামুর রহমানের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা ও দুর্নীতির মামলা করা হয়।পালিয়ে কিংবা আত্মগোপনে চলে যান আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি এবং নেতাকর্মীরা। অনেকে গ্রেফতারও হন। তাদের বিরুদ্ধে শত শত মামলা হয় দেশের বিভিন্ন এলাকায়।
গত সেপ্টেম্বরে ক্ষমতার অপব্যবহার দুর্নীতি ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে এনামুর রহমানের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ডা. এনামুর রহমানের নিজ নামে নগদ জমা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ আছে প্রায় ৬ কোটি টাকার। এছাড়া এনাম মেডিকেল হসপিটাল প্রাইভেট লিমিটেড, এনাম এডুকেশন এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভিলেজ (প্রাইভেট) লিমিটেড এবং এনাম ক্যান্সার হসপিটাল লিমিটেডে শত কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অজানা উৎস থেকে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তদন্ত শুরু করে। দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটের অনুসন্ধানে প্রাথমিক সত্যতা থাকায় তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আরও জানা গেছে, সাবেক প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন।
প্রাধমিক অনুসন্ধানকালে তার নিজ নামে নগদ জমা ৪৩ লাখ ৫৪ হাজার ৮৫৭ টাকা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা এক কোটি ৩৩ লাখ ২৩ হাজার ১১৮ টাকা সহ বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ হিসাবে তিন কোটি ৭৯ লাখ ৫০ হাজার টাকার সহ প্রায় ৪ কোটি টাকার খবর পাওয়া যায় বলে দুদক জানায়।
তথ্যানুসন্ধান দুদক সুত্র জানায়, তদন্তকালে প্রাপ্ত তার মোট স্থাবর সম্পদের মূল্য প্রায় ৫ শত কোটি টাকা, তার অবৈধভাবে অর্জিত জ্ঞাত-আয় বহির্ভূত সম্পদ সাভার, ধামরাই ও ময়মনসিংহে রয়েছে বলে গোয়েন্দা তথ্যানুসন্ধানে প্রমাণ পাওয়ায় অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
বিগত নির্বাচনের দেওয়া তথ্যানুযায়ী সাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমানের আয় ১০ বছরে বেড়েছে পাঁচ গুণের বেশি। অন্যদিকে এনামুরের চার স্ত্রীর নামে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ থাকলেও তাদের সম্পদের বিবরণ প্রকাশ করেন নি।
নির্বাচন কমিশনে এনামুর রহমানের জমা দেওয়া দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামা থেকে বেশ কিছু তথ্য গোজামিল করা হয়েছে।
২০২৩ সালে সাবেক প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানের বার্ষিক আয়ের উৎস ছিল দুটি শেয়ার, সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংক আমানত (এফডিআর ও ব্যাংক থেকে সুদ) এবং চাকরি (প্রতিমন্ত্রীর সম্মানী ভাতা)। এরপর এক দশকের ব্যবধানে তার আয় বছরে পাঁচ গুণের বেশি বেড়েছে। ২০২৩ সালের দেওয়া তথ্যানুযায়ী অনুযায়ী ১৫৮ কোটি টাকার অস্থাবর-স্থাবর সম্পদ রয়েছে।
তবে ২০২৩ সালের হলফনামায় স্ত্রীর সম্পদের স্থানে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। তবে পূর্বে দেওয়া ৪ জন স্ত্রীর মধ্যে কোন স্ত্রীর নামে কত সম্পদ তা খোলাসা করে বলা হয়নি। জানা যায়, তার বৈধ চার স্ত্রীর নামে দেড় শত কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে।এ ছাড়াও কোটি কোটি টাকার দেশের বাহিরে সিঙ্গাপুর ও যুক্ত রাজ্যেও তাদের সম্পদ রয়েছে বলে বিভিন্ন সুত্রে জানা গেছে। একাধিক সুত্র জানায় ,রানা প্ল্জাা ধসের পর বিদেশী শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করে এ সব সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলোেছন ডা: এনামুর রহমান ও তার ¯ী সন্তানেরা।
এ ছাড়াও ডা: এনামুর রহমান ২০১৭ সালে বিনা প্রতিদন্দিতায় এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর বেপরোয়া হয়ে উঠেন। তিনি সাভারে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বলতে গিয়ে পাঁচজনকে ক্রসফায়ারে দেয়ার কথা বলেছেন এবং বিএনপির ১৪ জনের তালিকা করার কথাও বলেছেন। সাভারে ক্রস ফায়ারের নামে ৮ বছর পূর্বে পৌর যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহ আলম নয়নকে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান সহ ৮ জনকে আসামি করে মামলার আবেদন করা হয়েছে। আদালত আবেদনটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্ত সেই মামলা এখনও তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা গেছে। আগস্ট বিপ্লবের পর এ নিয়ে স্থানীয় জনতা, বিএনপি নেতাকর্মীরা ও নয়নের স্বজনরা সাভার বাসস্ট্যান্ডে এক মানব বন্ধনও করেন। মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন সাভার পৌর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি বিশিষ্ট ব্যবসায়ি ওবায়দুর রহমান অভি, সাভার সদর ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ইউসুফ, পৌর বিএনপির সহ-সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম, সাভার পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আকবর হোসেন, নিহত যুবদল নেতার সহোদর সাবেক দুই ছাত্রদল নেতা আহসান উলাহ খোকন ও মাসুদ আলম লিটন, সাবেক ছাত্রদল নেতা নাঈমুল ইসলাম নঈম, পৌর শ্রমিক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আরিফুল ইসলাম আরিফ সহ বিএনপির কর্মরিা । মানববন্ধনে অংশ নিয়ে বক্তারা শাহ আলম নয়ন হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত করে দাবি পুলিশ সদস্য ও জড়িত অন্যান্যদের বিচার দাবি করেন। এই মামলার আর্জিতে তৎকালীন ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান, সাভার সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান, ওসি এস এম কামরুজ্জামান, ওসি (তদন্ত) মাহফুজুর রহমান, এস আই তন্ময় বিশ্বাস, এ এস আই আহসান কবির ও কনস্টেবল মামুনকে আসামি করা হয়েছে।
রানা প্লাজা ধসের পর ডা. এনামুর রহমান সাভারে তাঁর নিজম্ব ক্লিনিক এনাম মেডিক্যালে আহতদের চিকিৎসা দিয়ে আলোচনায় আসেন এবং প্রশংসিত হন। এরপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য হন তিনি এর আগে সাভারের সংসদ সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগেরই তালুকদার তৌহিদ জং মুরাদ।
এ ছাড়াও এম পি এনামের বিরুদ্ধে নিয়ম বহিবর্ভূত ভাবে অতিরিক্ত অর্থ আদায়সহ তার হাসপাতালে মৃত মানুষের লাশ আটকে রেখে টাকা আদায় করা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনায় পড়েন। গণ মাধ্যমে এ সব অনিয়মের সংবাদ ফলাও করে প্রকাশিত হলেও তিনি তার অধিনস্থ কাউকে বরখাস্থ করন নি বা ব্যবস্থা গ্রহন করেন নি।
গত আগস্টে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সাজ্জাদ হোসেন (২৯) নামে এক ছাত্রকে হত্যা করার দায়ে এনামুর রহমান সহ আওয়ামী লীগের ৩২১ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হয়েছে।এর পর বেশ কয়েকটি হত্যা ও হত্যা চেষ্টা মামলায় তিনি আসামী হন। সাভার মডেল থানার এ এস পি শাহিনুল কবির আলোর যুগ কে জানান, থানা তার বিরুদ্ধে ১৩ টি হত্যা মামলা ও ৪টি হত্যা চেষ্টা মামলা তদন্তাধীন রয়েছে।
২৭/০১/২৫
গ্রেফতার হওয়া সাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান। ফাইল ছবি