Thursday, December 26, 2024
Homeজাতীয়ফাঁস প্রশ্ন বেচে শত কোটি টাকা হতে চেয়েছিলেন জনপ্রতিনিধি

ফাঁস প্রশ্ন বেচে শত কোটি টাকা হতে চেয়েছিলেন জনপ্রতিনিধি

আলোর যুগ প্রতিনিধিঃ এক সময়ের কুলি সৈয়দ আবেদ আলী চাকরির খোঁজে ঢাকায় আসেন। গাড়ি চালাতে পারেন বলে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) পরিচালকের গাড়িচালক হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। পরবর্তী সময়ে দায়িত্ব পান পিএসসি চেয়ারম্যানের গাড়ি চালানোর। রূপকথার আলাদীনের জাদুর প্রদীপের মতো আবেদ আলী এই চাকরি পেয়ে শূন্য থেকে শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। ঢাকায় এখন তার বহুতল বাড়ি, তিনটি ফ্ল্যাট ও গাড়ি আছে। গ্রামের বাড়িতে আছে ডুপ্লেক্স ভবন। রয়েছে বাগানবাড়ি, ডেইরি ফার্ম। অঢেল সম্পদের মালিক আবেদ আলী হতে চেয়েছিলেন জনপ্রতিনিধি। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আবেদ আলী এসব তথ্য জানিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সিআইডির কর্মকর্তাদের ধারণা, আবেদ আলীর আরও বহু সম্পদ রয়েছে।

অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ ও নিজেকে রক্ষা করতে পূর্বপরিকল্পিতভাবে রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রকাশ করা এবং দুর্নীতির শিখরে থেকে ভালো মানুষ হিসেবে পরিচয় দেওয়ার জন্য ব্যবহার করেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং লোকদেখানো জনসেবা। আর এ কাজে তাকে সহযোগিতা করছে তারই ছেলে সোহানুর রহমান সিয়াম। বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত অভিযোগে গত সোমবার রাজধানীর শেওড়াপাড়ার ওয়াসা রোডের নিজ ফ্ল্যাট থেকে সৈয়দ আবেদ আলী ও তার বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান ওরফে সিয়ামকে গ্রেফতার করা হয়। একই সঙ্গে গ্রেফতার করা হয় পিএসসির দুজন উপপরিচালক, একজন সহকারী পরিচালকসহ আরও ১৫ জনকে। গতকাল পল্টন থানায় তাদের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মকমিশন আইনে মামলা করেছেন সিআইডির এক কর্মকর্তা। আবেদ আলীর ছেলে সোহানুর রহমান সিয়াম ছাত্রলীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। গতকাল ওই সংগঠন থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। মিরপুর থানার পশ্চিম শেওড়াপাড়ার ওয়াসা রোডের বিসমিল্লাহ টাওয়ার নামের একটি ৯ তলা ভবনের ফ্ল্যাটে সপরিবার থাকেন আবেদ আলী। ওই বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী সোহেল খান বলেন, আবেদ আলী পঞ্চম তলার একটি ফ্ল্যাটে দুই ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে থাকেন।

ওই এলাকার বাসিন্দাদের দাবি, ভবনটিতে আবেদ আলীর পাঁচটি ফ্ল্যাট ছিল। কয়েক মাস আগে দুটি ফ্ল্যাট তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন রয়েছে তিনটি। সিআইডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে আবেদ আলী পুলিশ কর্মকর্তাদের বলেছেন, শেওড়াপাড়ার ভবনটির পঞ্চম তলায় দুটি ও চতুর্থ তলায় একটি ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। পাইকপাড়ায় তার একটি ছয়তলা বাড়ি আছে। ব্যাংকে তার নগদ টাকা রয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে আবেদ আলী সিআইডির কর্মকর্তাদের বলেন, গত বছরের শেষের দিকে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে ৩ হাজার ১০০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের অনেকের কাছে ফাঁস করা প্রশ্ন বিক্রি করেছেন এবং তাদের চাকরিও হয়েছে। এদিকে পিএসসি সূত্রে জানা গেছে, সৈয়দ আবেদ আলী পিএসসিতে চাকরি নিয়েছিলেন ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে। তার বাড়ি মাদারীপুরে। তবে তিনি ঠিকানা দিয়েছিলেন সিরাজগঞ্জের। ২০১৪ সালে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় পিএসসির চাকরি থেকে তাকে বরখাস্ত করা হয়।

শত কোটি টাকার মালিক হওয়ার পর রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার জন্য হতে চেয়েছিলেন মাদারীপুর জেলার ডাসার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। সেই চাওয়া থেকে দীর্ঘদিন ধরে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনের জন্য প্রচার-প্রচারণাও চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আবেদ আলীর ব্যক্তিগত ফেসবুক প্রোফাইলে আপলোডকৃত বিভিন্ন ভিডিও ও পোস্টে দেখা যায়, এলাকাভিত্তিক জনসভায় নিজেকে একজন সংগ্রামী ও ত্যাগী মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করেন তিনি। গত ১২ জুন আবেদ আলী তার ফেসবুকের এক পোস্টে লেখেন, ‘আমার জীবনে কোনোদিন অসদুপায় অবলম্বন করিনি। গায়ে খেটে ভাগ্য পরিবর্তন করেছি।’ আরেকটি  ভিডিওতে আবেদ আলী নিজেকে নিতান্তই সাধারণ মানুষ হিসেবে দাবি করেন। তিনি বলেন, আমার কোটি কোটি টাকা নাই, তবে জনগণের ভালোবাসা অর্জন করার ক্ষমতা ঠিকই রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ের আপলোড করা ভিডিতে দেখা যায়, ডাসার উপজেলায় বিভিন্ন সময়ে জনসাধারণের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছেন। নিজেকে ভালো মানুষ হিসেবে দাবি করা আবেদ আলী এখানেই থামেননি। টাকার পাহাড় করার পর পাল্টে ফেলেছেন নিজ বংশ উপাধিও। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আবেদ আলীর বিত্তবৈভবে ফুলে ফেঁপে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মীর উপাধি পাল্টে নামের আগে সৈয়দ উপাধি ব্যবহার করেন। আবেদ আলীর সম্পদের প্রাথমিক তথ্য মারফত জানা যায়, যে পরিমাণ টাকা তিনি বাগিয়ে নিয়েছেন, তাতে হয়ে গেছেন গ্রুপ অব কোম্পানির মালিক। গ্রামে তৈরি করেছেন ডুপ্লেক্স বাড়ি। পাশে নিজের নামে তৈরি করেছেন মসজিদ। রয়েছে ডেইরি ফার্ম ও বাগানবাড়ি। রাস্তার পাশে সরকারি জায়গা দখল করে তৈরি করেছেন মার্কেট। নিজ এলাকায় শতবিঘার ওপরে জমি কেনার পাশাপাশি কুয়াকাটায় তৈরি করেছেন থ্রি স্টার হোটেল সান মেরিনো। ঢাকার মিরপুর ও উত্তরায় রয়েছে দুটি বহুতল বাড়ি।

গ্রেফতারের পর গণমাধ্যমের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আবেদ আলীর কাছে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল প্রশ্ন ফাঁসে কত টাকা ইনকাম করেছেন? জবাবে আবেদ আলী বলেন, ‘প্রশ্ন ফাঁসে যত টাকা কামাই করেছি, সব খরচ করেছি আল্লাহর রাস্তায়।’ এদিকে সৈয়দ আবেদ আলীর সঙ্গে একই গতিতে ছুটছিলেন তার প্রিয় পুত্র সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম। সিয়াম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বরাবরই থাকতেন সরব। বাবার এবং নিজের সামাজিক কর্মকান্ড ফেসবুকে পোস্ট দিতেন সবসময়। বাবাকে নিয়ে তার গর্বেরও শেষ ছিল না। এক পোস্টে বাবা আবেদ আলীকে নিয়ে সিয়াম লিখেছিলেন, সন্তান হিসেবে গর্ব করার মতো অনেক কিছু দিয়েছেন এই মানুষটা। বিনিময়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ পাইনি কখনো। জন্মের পর থেকে কোনো কিছু চাইতে হয়নি। প্রয়োজন অনুভব করার আগেই পেয়ে গেছি। তিনি ওই পোস্টে আরও উল্লেখ করেন বাবার  রক্তে-ঘামে অর্জিত সাম্রাজ্য ভোগ করছি আমরা তিন ভাই-বোন। আমাদের কাছে তিনিই সব। আমার জীবনের সমস্ত গল্পের একমাত্র হিরো আমার বাবা। বাবার উত্থানের গল্প বলতে গিয়ে তিনি বলেন, আমার বাবা একদম ছোট থেকে বড় হয়েছেন। আমার বাবার বয়স যখন ৮ বছর, তখন পেটের দায়ে তিনি ঢাকায় চলে গেছেন। ঢাকায় গিয়ে কুলিগিরি করে ৫০ টাকা রুজি দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। তিনি এখন একটি লিমিটেড কোম্পানির মালিক। তিনি কষ্ট করে বড় হয়েছেন।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments