অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইউপি চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলামের ক্যাডার বাহিনীর মধ্যে রয়েছে মাহবুব (দল নেতা), রিয়াজ, রিয়াদ মোল্লা, গাউছ, দাউদ, সুলতান, পান্নু, তমাল, ফরহাদ, সবুজ, ওয়াসিম গাজী, রতন ওরফে পাগলা রতন, কামরুল, ফাহিম, মিলন, রোমেল, আজাদ, কালাম, ছোট মাহবুব, সেকেন্দার, নজরুল, সোহেল, সুমন, জাকির, আব্দুল আল কাদির, রানা, কুদ্দুস, নজরুল, সাফি। আর বেতন ছাড়া চেয়ারম্যানের বিভিন্ন অবৈধ কাজ করে দেওয়ার বিনিময়ে সুবিধা পাওয়ার মধ্যে ওয়েলকাম মিন্টু, চান মিয়া, সজিব, সুমন, তুষার, আল-আমিন সরকারসহ আরও প্রায় ২০ থেকে ৩০ জন সদস্য রয়েছে।
চেয়ারম্যানের এই ক্যাডার বাহিনীর দল নেতার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মাহবুবকে। প্রতিমাসের প্রথম সপ্তাহে সন্ধ্যার দিকে পল্লীবিদ্যুৎ এলাকার লাবনী রেস্টুরেন্টে বসে চেয়ারম্যান তার এই ক্যাডার বাহিনীর সদস্যদের মাসিক বেতন দেন।
জানা গেছে, ক্যাডার গ্রুপের মধ্যে সবুজ ও ফাহিম পল্লীবিদ্যুৎ এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। এর আগে ইয়াবাসহ ঢাকা জেলা উত্তরের গোয়েন্দা পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে একটি মামলাও দায়ের করা হয়েছে।
আমিন মডেল টাউন এলাকার বাসিন্দা তরিকুল ইসলাম ভুইয়া বলেন, ‘আমার ভাই সাবেক সেনা সদস্য আরিফ বিল্লাহ (সার্জেন্ট) ক্যান্টনমেন্ট এলাকার পাশের আমিন মডেল টাউন এলাকায় নিজেদের একটি বাড়ি নির্মাণের কাজ করছিলেন। পরে ইউপি চেয়ারম্যান সাইফুলের সন্ত্রাসী বাহিনী আমার ভাইয়ের কাছে চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না দেওয়ায় সন্ত্রাসীরা আমর ভাইকে মুঠোফোনে ডেকে নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে।’
এ হত্যাকাণ্ডের তদন্তকারী কর্মকর্তা আশুলিয়া থানার উপ পরিদর্শক এস আই মনিরুজ্জামান বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত এই সন্ত্রাসীরা এলাকার চিহ্নিত ব্যক্তি। তারা প্রথমে ওই সেনা সদস্যের নির্মাণাধীন ভবনে ইট, বালু, সিমেন্ট দেওয়ার কথা বলে ঠিকাদারি কাজ নেয়। এর পর থেকেই নিম্নমানের ও কম মালামাল সরবরাহ করে পুরো টাকা দাবি করতে শুরু করে। এক পর্যায়ে সেনা সদস্য এর প্রতিবাদ করে তাদের ঠিকাদারি বাতিল করে দেন। এ কারণে তার কাছে নগদ কয়েক লাখ টাকা চাঁদা চায় সন্ত্রাসীরা। চাঁদা না দেওয়ার কারণেই ওই সেনা সদস্যকে মুঠোফোনে বাড়ি থেকে ডেকে এনে হত্যা করা হয়।’
সেনা সদস্যের ভাই অভিযোগ করে আরও বলেন, পল্লীবিদ্যুৎ এলাকায় কেউ নতুন বাড়ি নির্মাণ করলেই চেয়ারম্যানের লোকজনকে চাঁদা দিতে হয়। না হলে বাড়ির কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আশুলিয়ার শ্রীপুর এলাকার গেদুরাজের ছেলে কাউছার অভিযোগ করেন, তার ভাই শাহিন স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল। তাকে দমানো এবং তার ডিশ ও ময়লার ব্যবসা দখলের জন্য চেয়ারম্যানের সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্য গাউছ, রিয়াজ, পান্নু, সুমন ও নাদিমসহ আরও বেশ কয়েকজন তার ভাইকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় তারা চেয়ারম্যানের ক্যাডার সদস্যদের নামে হত্যা মামলা দায়ের করেন। এরপর থেকে তার পুরো পরিবার চেয়ারম্যানের লোকজনের হামলার আতঙ্কে রয়েছেন। গত কয়েকমাস তার বাবা ও তিনি চেয়ারম্যানের সন্ত্রাসী বাহিনীর ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের আশুলিয়া থানা সেক্রেটারি রাজা মোল্লা বলেন, ‘চেয়ারম্যান সাইফুলের ক্যাডার বাহিনী বাইপাইল এলাকায় আমার কাউন্টার থেকে চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না দেওয়ায় প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জনের একদল সদস্য অস্ত্র নিয়ে আমার ওপর হামলা চালিয়ে কুপিয়ে জখম করে। এ ঘটনায় আমি নিজে বাদী হয়ে ক্যাডার সদস্যদের নামে মামলা করেছি।’ সাইফুলের নামে মামলা করলে তার পুরো পরিবার প্রাণনাশের হুমকিতে পড়ে যাবে বলে তাকে বাদ দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
ইউপি চেয়ারম্যানের বাহিনীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক এক ক্যাডার সদস্য বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঘটনার কথা স্বীকার করে একটি মিডিয়া কে বলেন, ‘২০১৬ সালে ইউপি নির্বাচনে সাইফুল ইসলাম চেয়ারম্যান হওয়ার এক বছর পর আমি তার ক্যাডার বাহিনীতে যোগ দেই। শুরুতে প্রতিমাসে ১০ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হতো। আমি একটি জমি দখল ও পোশাক কারখানার ঝুট ব্যবসা দখলের কাজ করেছি। চেয়ারম্যানের প্রতিটি মিশনেই দেশীয় অস্ত্রসহ বিদেশি পিস্তল ব্যবহার করা হতো। পলাশবাড়ি এলাকায় ৯০ শতাংশের একটি জমি দখলের সময়ও সঙ্গে ছিলাম। পরে ব্যক্তিগত কারণে সরে আসি।’
আশুলিয়ায় বাইপাইল ও নবীনগর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বিভিন্ন গাড়ির চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নবীনগর-চন্দ্রা ও আব্দুল্লাপুর-বাইপাইল মহাসড়ক দিয়ে চলাচলরত যানবাহন থেকে চাঁদা আদায় করে চেয়ারম্যানের লোকজন। এরমধ্যে ওয়েলকাম ও মৌমিতা পরিবহনের প্রায় ১৫০টি বাস থেকে ৩০ টাকা করে, আশুলিয়া ক্লাসিকের প্রায় ১১০টি বাস থেকে ২৪০ টাকা ও প্রায় ৫০টি মিনিবাস থেকে ১২০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়।এমনকি তাদের হাত থেকে বাদ যায়নি স্থানীয় সড়ক দিয়ে চলাচলরত অটোরিকশাও। পল্লীবিদ্যুৎ এলাকার আমিন মডেল টাউন স্কুলের সড়ক দিয়ে প্রায় ২৫টি অটোরিকশা চলাচল করে। প্রতিদিন এসব অটোরিকশা থেকে মাহবুবের লোকজন ৭০ টাকা করে আদায় করে।
এ ব্যাপারে সাইফুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি মাহবুব, গাউছ, পান্নুসহ বেশ কয়েকজন তার হয়ে কাজ করে বলে স্বীকার করেন। এছাড়াও তার সঙ্গে থাকার কারণে তিনি তাদের বেতন দেওয়ার কথাও স্বীকার করেন। তবে এদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘তারা গোপনে পরিবহন বা অন্য কোনও সেক্টর থেকে চাঁদা আদায় করে থাকতে পারে। তবে এ বিষয়ে আমার জানা নেই।’ এছাড়াও জমি দখল ও হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি। অন্যদিকে, তার ওই গ্রুপের মধ্যে সবুজ ও ফাহিম নামের দুই মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি তাদের চিনেই না বলে দাবি করেন।
এ ব্যাপারে সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাসিনা দৌলার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা মুজিব আদর্শের সৈনিক। তবে বর্তমানে কিছু লোকজন আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে কী পেলো আর কী পেলো না সেই হিসাবই করে।’ ইউপি চেয়ারম্যানের লোকজনের বিষয়ে তিনি কোনও কথা বলতে রাজি হননি। তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করতে বলেন।
স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ধরনের বিষয় তার জানা নেই। তবে তিনি এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। প্রয়োজনে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানান মন্ত্রী।
সাভার সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তাহমিদুল ইসলাম একটি অনলাইন পোর্টালকে বলেন, ‘পরিবহন থেকে চাঁদা, দখলদারি এসব আদায় সম্পূর্ণ অন্যায় কাজ। কেউ যদি এ ধরনের কর্মকাণ্ড করে থাকে তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এখন পর্যন্ত কেউ এ বিষয়ে কোনও অভিযোগ করেনি।’ বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথাও জানান তিনি।
ঢাকার জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবু সালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান বলেন, ‘একজন ইউপি চেয়ারম্যান তার লোকজন দিয়ে পরিবহন বা যে কোনও সেক্টর থেকে চাঁদা আদায় করতে পারেন না। এ ধরনের কোনও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
এই বিষয়ে ওয়েলকাম, মৌমিতা ও আশুলিয়া ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের পক্ষ থেকে বলা হয়, সড়কে চলাচলকারী যানবাহন থেকে ইউপি চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলামের চাঁদা আদায়ের অভিযোগ মিথ্যা। তাকে হ্যয় করার জন্যই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হচ্ছে।
আশুলিয়ার মৌমিতা, আশুলিয়া ক্লাসিক ও ওয়েলকাম মিনিবাসের একাধিক চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাইপাইল ও নবীনগর বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে জিপি বাবদ চাঁদার টাকা উঠানো হয়। ইউপি চেয়ারম্যানের লোক মিন্টু এসব পরিবহন থেকে চাঁদা আদায়ের পর প্রতি মাসে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তিকে সেই টাকা ভাগ-ভাটোয়ারা করে দিয়ে থাকেন, যার একটি বড় অংশ ইউপি চেয়ারম্যানকেও দেওয়া হয়। এসব পরিবহনের একাধিক চালক, স্টাফ ও কর্মীর এ বিষয় বক্তব্যে দিয়েছন যা রেকর্ড করা আছে।
আরো বিস্তারিত পরবর্তী পর্বে….